দুই প্রকৌশলী’র কব্জায় সিদ্ধিরগঞ্জের ডিপিডিসি
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ১১:১৮ পূর্বাহ্ন, ১০ই নভেম্বর ২০২৪
# দালাল ও বহিরাগত চক্রের সঙ্গে কক্সবাজারে আনন্দ ভ্রমন
# টাকা ছাড়া মেলে না সেবা, টাকা দিলেই অবৈধ সংযোগ
# জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত
-ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
# চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে
-ড. ইকবাল মাহমুদ, সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক
# বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে
-কিউ.এম শফিকুল ইসলাম, পরিচালক (অপারেশন) ডিপিডিসি
দুর্নীতি, অনিয়ম আর ক্ষমতার অপব্যবহারের কত রূপ, তা দেখাচ্ছেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম । বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদ গড়ার পাশাপাশি অসাধু উপায়ে কামাচ্ছেন কাড়িকাড়ি টাকা। ক্ষমতার দাপটে কাউকেই যেন গ্রাহ্য করেন না। টাকা ছাড়া কিছুই বোঝেন না এই দাপুটে দুই কর্মকর্তা। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি অভিযোগ পত্র জমা পড়েছে। এ ছাড়াও তারা দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে মিলেছে সত্যতাও। টাকা দিলেই মেলে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ।
গত ৭ আগস্ট এই দালাল চক্র নিয়ে বাংলাদেশ বিমানে একটি ফ্লাইটে কক্সবাজারে আনন্দন ভ্রমনে গেছেন এই দুই প্রকৌশলী। সব খরচ দিয়েছেন উপসহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম। এই ট্যুরে খরচ হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টাকারও বেশি। প্রধান অতিথি ছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী। দালাল সদস্যদের নিয়ে এতো আয়োজন দেখে হতবাগ সিদ্ধিরগঞ্জের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী। তারা অভিযোগ করেন, অমিত স্যার সারওয়ার-এ-আলম দিয়ে পুরো ডিভিশনে ঘুষের বাণিজ্য শুরু করেছেন। এতো দুর্নীতি করেও কোন কারিশমায় পার পেয়ে যাচ্ছেন প্রশ্ন প্রকৌশলীদের।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী ও উপসহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম অবৈধভাবে টাকা আয়ের জন্য নানা অজুহাতে প্রতিনিয়ত সাধারণ গ্রাহকদের হয়রানি করছেন। তার অত্যাচারে গ্রাহকরা অতিষ্ঠ। অবৈধভাবে টাকা আয় যেন তাদের নেশা ও পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব করতে তারা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমাফিক যা খুশি তাই করছেন। বৈধ পন্থায় কেউ বিদ্যুতের সংযোগ নিতে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জমা দিলেও লোড নাই কিংবা ট্রান্সফর্মার সংস্কার হবে তার আগে সংযোগ দেয়া যাবে না এমন সব কল্পনাপ্রসূত মনগড়া অজুহাত দিয়ে গ্রাহককে হয়রানি করে থাকেন। আবার অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে কিংবা ঘুষ দিলে মুহূর্তেই সংযোগ দেয়া হয়, তাতে যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে ঘাটতিও থাকে।
এভাবে ডিপিডিসির সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনে অনিয়ম-দুর্নীতির এক অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন প্রকৌশলী অমিত অধিকারী। এরইমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে হওয়া অভিযোগপত্রটি অনুসন্ধান শুরু করবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেন। সূত্র বলছে, সিএসএস সুপারভাইজার সুমন চন্দ্রসহ ১০/১২জন মিটার রিডার ও বহিরাগত একটি দালাল সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম। সব সময় সিন্ডিকেটের সদস্যরা তার রুমে অবস্থান করেন। সম্প্রতি অনিয়মের কৌশল ও পরিকল্পনা করছিলেন বিদ্যুৎ কর্মকর্তা মো.সারওয়ার-এ-আলম।
এ সময় ওই রুমে গ্রাহক ছদ্মবেশি হঠাৎ এক সংবাদকর্মী প্রবেশ করতেই উত্তেজিত হয়ে উঠেন এই বিদ্যুৎ কর্মকর্তা। এ সময় তার টেবিলে টাকা লেনদেন চলছে এমন চিত্র দেখা যায়। কেনো জিজ্ঞেস না করে রুমে প্রবেশ করলেন সংবাদকর্মী এই নিয়ে খুব দুর্ব্যবহার করেন মো.সারওয়ার-এ-আলম। ভুল স্বীকার করে রুম থেকে সরে আসেন ওই সংবাদ কর্মী। এই বিদ্যুৎ কর্মকর্তার নির্দেশেই অনিয়ম ও গ্রাহক হয়রানী করছে দালাল চক্র ও বহিরাগতরা। জানা গেছে, ডিপিডিসির নিয়ম অনুযায়ী এলটিআই রিডিং উপ-সহকারী মো.সারওয়ার-এ-আলমের নেয়ার কথা।
কিন্তু তিনি নিজে না গিয়ে বহিরাগত চিহ্নিত দালাল মো: আক্তারকে দিয়ে রিডিং ও বিল সরবারহ করে থাকেন। সিদ্ধিরগঞ্জে ডিপিডিসির বোর্ডে চিহ্নিত দালাল হিসেবে আক্তারের ছবি টানানো রয়েছে। তবুও এই আক্তারকে দিয়ে সব কাজের তদারকি করাচ্ছেন উপ-সহকারী মো.সারওয়ার-এ-আলম। তিনি প্রতি সপ্তহে ফাইল বণিজ্যে করে আয় করেন লাখ লাখ টাকা।
এদিকে প্রতি দুই কিলো লোডের জন্য গ্রাহককে গুনতে হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। যদি গ্রাহক সোলার লাগাতে অনিহা প্রকাশ করেন সেই সব গ্রাহকদের নানা অজুহাতে আরো গুনতে হয় ২ থেকে ৩ গুন টাকা। দালাল আক্তারের কাছ থেকে এলটি বিলের নামে আদায় করা হয় ৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়াও উপ-সহকারী মো.সারওয়ার-এ-আলমের নেতেৃত্বে দালাল আক্তারকে দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের ৪০/৪৫টি ব্যাটারি চালিত অটো রিকশার গ্যারেজ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। প্রতিদিন রাত ১০টা থেকে সকাল ৫টায় পর্যন্ত চলে এই অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি টাকার বেশি। আর নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পকেটে যাচ্ছে ২০ লাখ টাকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে গত ৭ আগস্ট নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলমের নেতেৃত্বে ১৭ জনের একটি সিন্ডিকেট বাংলাদেশ বিমানে একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার আনন্দ ভ্রমনে যান। যেখানে তারা সি-প্লেজ হোটেলে রাত-যাপন করেন। তিন দিন পর নির্বাহী প্রকৌশলী ১৬জনের বহন নিয়ে ফিরে এলেও ৫দিন পর ফিরেন মো.সারওয়ার-এ-আলম।
এর আগেও মো.সারওয়ার-এ-আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও অদৃশ্য শক্তির বলে বদলির বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে প্রতি দুই মাস পর পর মিটার রিডার ও বহিরাহত চিহ্নিত দালাল চক্রের সদস্যদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম।
ঘুষের মহোৎসব: ঘুষ ছাড়া কাজই হয়না। ঘুষ না দিলে হতে হয় নানা রকম হয়রানি। অনিয়ম এখন সেখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। মিটার রিডার ও দালাল চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে প্রকৌশলীরা ঘুষ লেনদেন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ ডিপিডিসির কর্মকর্তারা ঘুষ ছাড়া যেন কিছুই বুঝেন না।
প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম ও অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জানা গেছে, গ্রাহক হয়রানির নানা দুর্নীতিসহ ঘুষ বাণিজ্যের আখড়ায় পরিণত হয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ ডিপিডিসি। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে সিদ্ধিরগঞ্জ ডিপিডিসির বিরুদ্ধে। প্রকৌশলী থেকে শুরু করে মিটার রিডাররা সবাই দুর্নীতিবাজ।
প্রকৌশলী অমিত ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছেন রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিদ্ধিরগঞ্জ ডিপিডিসির কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। কোন গ্রাহক যদি নতুন কোন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করে তাহলে সাইট প্রকৌশলীরা প্রথমে ফাইল প্রসেস করার জন্য দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। তারপর বহুতল ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ ও মিটার বাবদ কয়েক লাখ টাকা নিচ্ছে তারা। কোন গ্রাহক যদি ডিপিডিসি কর্মকর্তাদের চাহিদা মত টাকা দিতে না পারে তাহলে ওইসব গ্রাহকদের নানা অজুহাতে বিভিন্ন হয়রানি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভুগি এক গ্রাহক বলেন, আমি ৬ তলা ভবন করেছি। ভবনে মোট ফ্ল্যাট সংখ্যা রয়েছে ১২টি। ১২টি মিটারের জন্য সিদ্ধিরগঞ্জ ডিপিডিসিতে আবেদন করি। ডিপিডিসির উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.সারওয়ার-এ-আলম ভবন পরিদর্শন করে। পরে বড় কর্তাদের অজুহাতে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। পরে বাধ্য হয়ে চাহিদা মোতাবেক টাকা দিয়ে দিই। অথচ সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিলো। এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদক খোঁজ-খবর নিলে এবং গোপনে গ্রাহকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এদিকে গত ১৯ সেপ্টেম্বর মের্সাস গ্রীন এমএফজি কো:(গ্রাহক নং ১৪৮৫১১৬৩), যার ১৮ কিলো লোড থেকে ৪০ কিলো লোড বৃদ্ধি করা হয়। সিঙ্গেল ফেজ মিটার পরিবর্তন করে থ্রী ফেজ মিটার দেওয়া হয়েছে। কোনো প্রকার সোলার ব্যবহার না করেই এবং কাগজপত্র যাছাই-বাছাই ছাড়াই অবৈধ ভাবে এই সংযোগ অনুমোদন করেন নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী ও উপ-সহকারী সারওয়ার-এ-আলমসহ তিন কর্মকর্তার সাক্ষর রয়েছে অনুমোদ পত্রে। এই সংযোগ প্রদানে গ্রাহকের নিকট থেকে ২ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক বলেন, মিটার রিডারের মাধ্যমে প্রকৌশলীরা ঘুষ লেনদেন করে থাকেন। এসব দুর্নীতিবাজদের রয়েছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। মের্সাস গ্রীন এমএফজি কো: এর কোনো প্রকার কাজগপত্র ছাড়াই সংযোগ পেয়েছেন। টাকা হলেই সব করা যায় এই ডিভিশনে।
তিনি আরও বলেন, ডিপিডিসির এক লাইনম্যানের সিদ্ধিরগঞ্জে কয়েকটি বহুতল বাড়ি রয়েছে। তাই এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের দাবি জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে ডিপিডিসির সিদ্ধিরগঞ্জ ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিত অধিকারী বলেন, আনন্দ ভ্রমনে গিয়েছি তাতে কি হয়েছে। আপনি যা ইচ্ছে তাই লিখেন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না।
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দুর্নীতিবাজ যে হউক তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের বের করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দুর্নীতি থাকলে দেশে সুশাসন থাকবে না।
এ ব্যাপারে ডিপিডিসির পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী কিউ.এম শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদ্যুৎ সংযোগে গ্রহকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কেনো সুযোগ নেই। প্রমান পেলেই ব্যবস্থা।
আরএক্স/