ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী
গণপূর্তের মাফিয়া সাইফুজ্জামান চুন্নু
বশির হোসেন খান
প্রকাশ: ০৫:০৬ অপরাহ্ন, ২৯শে জানুয়ারী ২০২৫
# ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালানো সেই হাসান মোল্লা সঙ্গে চুন্নু’র সখ্যতা
# কাজ না করে আইভি বাংলো তৈরির সরকারি অর্থ আত্মসাতে অভিযোগ
# বদলি,টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কমিশনের বিনিময়ে কাজ ভাগিয়ে নিতেন তিনি
# মন্ত্রীর পিএ আবু মূসা আনসারিকে দামী গাড়ি উপহার দিয়েছেন তিনি
# ব্যবস্থা নিতে হবে
ড. ইকবাল মাহমুদ, সাবেক চেয়ারম্যান,দুদক
# তদন্ত হওয়া দরকার
ড. ইফতেখারুজ্জামান নির্বাহী পরিচালক টিআইবি
ফরিদপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু’র ঘরে আলাদিনের চেরাগ। অভিযোগ রয়েছে কর্মজীবনের শুরু থেকেই দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে গড়েছেন সখ্যতা। দুর্নীতির মাধ্যমে অল্প কিছুদিনের মধ্যে গড়ে তুলেছে শতশত কোটি টাকার সম্পদ ও নগদ অর্থ। বিদেশে অর্থ পাচারের পাশাপাশি বাড়িও কিনেছেন দেশের বাইরে।
দেশের মাটিতেও গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য। গণপূর্ত ঢাকা মেট্রো জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় করে টেন্ডারে অনিয়ম করে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন এই দাপুটে কর্মকর্তা। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জালিয়াতি ও দুর্নীতির শীর্ষ গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু। বরিশালের পটুয়াখালি সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয় দুর্নীতি দমন কমিশনে একটা একটি অভিযোগ পত্র জমা পড়েছে।
আরও পড়ুন: গণপূর্তে হরিলুটের মাস্টার প্রকৌশলী চুন্নু
সূত্র বলছে, প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা পটুয়াখালিতে গড়ে তুলেছেন নাহিয়ান ব্রীকস ফিল্ড, পটুয়াখালি কলেজ রোডে দু’তলা বাড়ী, পটুয়াখালি সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ ধারান্দি গ্রামে ৫ একর জমি, পটুয়াখালিতে নেক্সাস নামে একটি গামেন্টস এর শোরুম, সাভারে ১০ কাঠার একটি প্লট, ঢাকা ধানন্ডির সেন্ট্রাল রোডে একটি ফ্ল্যাট, বেইলী রোডে একটি ফ্ল্যাট, এছাড়াও রয়েছে নামে বেনামে অসংখ্য সম্পদ। গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে আইভি বাংলো তৈরির সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে লাখ টাকার নিচে বেতনে কিভাবে এতো সম্পদশালী তিনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে বদলি,টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কমিশনের বিনিময়ে কাজ ভাগিয়ে নেয়া,কাজ না করে বিল উত্তোলন করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাবেক গণপূর্ত মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়ার জন্য মন্ত্রীর পিএ আবু মূসা আনসারিকে দামী গাড়ি উপহার করেছেন তিনি।
দুদকের অভিযোগে বলা হয়, গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে আইভি বাংলো তৈরির সরকারি অর্থ আত্মসাত করেন এই প্রকৌশলী। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব মুহাম্মদ সোহেল হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানা যায়। চিঠির স্মারক নম্বর- ২৫.০০.০০০০.০৫৩.০০১.০০২.১৯.২৭১। অভিযোগটি গত ২৩ আগস্ট করা হয়।
অভিযোগের বিষয়ে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন প্রদানের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব মুহাম্মদ সোহেল হাসানকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেই প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ সোহেল হাসান গত ২১ আগস্ট গণপূর্ত অধিদপ্তরের মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে আইভি বাংলোতে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে দেখা যায়, মিরপুর পাইকপাড়াস্থ পিডব্লিউডি ট্রেনিং সেন্টার (পুরাতন) এর ২য় তলার সিড়ির পূর্ব পাশের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত কক্ষ নম্বর ৭ ও ৮ দুটি কক্ষকে আইবি বাংলোতে রূপান্তরের জন্য মেরামত ও আধুনিকায়ন কাজের জন্য ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের বরাদ্ধকৃত অর্থ ইতোমধ্যে উত্তোলনপূর্বক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদান করা হয়েছে।
কিন্তু ওই ৭ ও ৮ নম্বর কক্ষে কোনো মেরামত বা আধুনিকায়নের কাজ করা হয়নি। তবে ৭ নম্বর কক্ষে দুই শ্রমিককে তড়িঘড়ি করে ডেকোরেশনের কাজ শুরু করেই বন্ধ হয়ে যায়। তদন্তের স্বার্থে নতুন করে কোনো কাজ না করার জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যান্য প্রকৌশলীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে ওই দুটি কক্ষে যেনো কোনো মেরামত কাজ না করতে পারে সেজন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী (সংস্থাপন) আহমেদ আব্দুল্লাহ নূর ও নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম) পবিত্র কুমার দাশ এর সহযোগীতায় উক্ত কক্ষ দুটিতে সিলগালা করার নির্দেশ দেন। যা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন অধিশাখা-০৯) মো. মাহমুদুর রহমান হাবিবকে অবহিত করা হয়।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, মিরপুর ডিভিশনের পূর্ত সার্কেলে এই অর্থ আত্মসাৎই নয়, সাইফুজ্জামান চুন্নুর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গত ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হেলমেট পরা অবস্থায় পিস্তল হাতে গুলি চালাতে দেখা যায় এক যুবককে। এমন একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে। পরিচয় মিলেছে তার। তিনি গণপূর্তের ঠিকাদার হাসান মোল্লা। ঢাকা কলেজের সাবেক এই ছাত্রকে অন্যকম ঠিকাদার হিসেবে সব সময় সহযোগিতা করেন গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু। সব সময় ঠিকাদার হাসান মোল্ল কে জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দিতেন। তা ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান ছিলো এই নির্বাহী প্রকৌশলীর। নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নুর বিরুদ্ধে অনিয়ম ছাড়াও সম্প্রতি একটি বিষয় সামনে চলে আসে।
এ সব বিষয়ে ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সাইফুজ্জামান চুন্নু বলেন, আমি ঢাকায় নাই। আগে ভালো ছিলাম। এখন ভালো নেই। আপনি যা ইচ্ছে তাই লিখেন। আমার কিছু করার নেই।
আরও পড়ুন: গণপূর্তে হরিলুটের মাস্টার প্রকৌশলী চুন্নু
এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই দুর্নীতিবাজ যে হউক চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার যে বৈধ আয়, তার সঙ্গে সম্পদের পরিমাণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি যে সম্পদ অর্জন করেছেন, সেটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। তার কাছে যে ক্ষমতা ছিল, সেটির অপব্যবহার করেছেন তিনি। সেটি ব্যবহার করেই তিনি এই সম্পদ গড়েছেন। আর এই সম্পত্তি যে তিনি একা করেছেন, সেটা কিন্তু ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তার সঙ্গে অনেক যোগসাজশকারী ও সহায়তাকারী রয়েছে। এখন এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার এবং জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।
আরএক্স/