জীবনানন্দের স্মৃতি বিজড়িত ধানসিড়ি নদী কেটে খাল বানিয়েছে ঠিকাদাররা


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


জীবনানন্দের স্মৃতি বিজড়িত ধানসিড়ি নদী কেটে খাল বানিয়েছে ঠিকাদাররা

আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে; বলেছিলো: ‘এ নদীর জল তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল: সব ক্লান্তি রক্তের থেকে স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি; এই নদী তুমি।’ ‘এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?’ মাছরাঙাদের বললাম; গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম। আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি; জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে। সময়ের অবিরল সাদা আর কালো বনানীর বুক থেকে এসে মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী। প্রকৃতির প্রেমী কবি জীবনানন্দ দাস তার “সে” কবিতায় ধানসিড়িকে নিয়ে এভাবেই আবেগাপ্লুত কবিতা রচনা করেন। 'এর নাম ধানসিড়ি বুঝি?' এ প্রশ্নের পর কবিতায় জীবনানন্দ দাশ যা লিখেছেন, তা থেকে বোঝা যায়, প্রশ্নটা মাছরাঙাদের। উত্তরে বলা হলো, 'মাছরাঙাদের বললাম;/ গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।/ আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;/ জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে/ কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।' ধানসিড়ি তীরে এখন যে কেউ দাড়ালেই মনে প্রশ্ন জাগবে, 'এর নাম ধানসিড়ি বুঝি?' 

বাংলাদেশের অন্য সব নদীর চেয়ে খুব স্বতন্ত্র কিছু নয় ধানসিড়ি। অথচ জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সবচেয়ে  বেশি যে নদীটির নাম এসেছে, তা এই ধানসিড়ি। জন্মান্তরে কবি এ নদীতীরে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছিলেন, 'আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়তোবা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়।'

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতিবিজড়িত ঝালকাঠির ঐতিহ্যবাহী ধানসিড়ি নদী পুনঃখননে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান  বেকুর মেশিন দিয়ে নদীর দু'পাড় থেকে মাটি কেটে পাড়েই এমন ভাবে রাখছে, বৃষ্টি হলেই মাটি ধুয়ে পুনরায় নদী ভরাট হয়ে যাবে। এ ছাড়া এখনই খননকৃত নদীর পাড়  ভেঙে পড়ছে এবং নদীর মাঝে মাঝে বাঁধ রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ ধানসিড়ি নদী কেটে এখন খাল করা হচ্ছে। ধানসিড়ি খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে চিরতরে নদীটি বিলীনের মুখে ফেলছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় রাজাপুর বাগড়ি এলাকায় ধানসিড়ি রক্ষার দাবিতে মঠবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে এলাকাবাসী। বরিশাল-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার বাগড়ি বাজার স্কুল এলাকায় এ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। স্থানীয়দের আয়োজিত এ মানববন্ধন কর্মসূচি শেষে বাগড়ি বাজার এলাকায় সংক্ষিপ্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দখল আর পলিতে দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে খনন না হওয়ায় নদীটি ভরাট হয়ে মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে খনন কাজ শুরু করা হলেও তা সরুভাবে খনন করে একদম খালে পরিণত করা হচ্ছে। নদীটি সঠিকভাবে খনন করে পূর্বের ন্যায় নৌ যান চলাচলের ব্যবস্থা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সু দৃষ্টি কামনা করেন। মানববন্ধনে মঠবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শাহ জালাল হাওলাদার,  রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আউয়াল গাজি, যুবলীগ সহসভাপতি সুবর হাওলাদার, সাধারন সম্পাদক ফখরুল ইসলাম খান, মজিবর রহমান, নজরুল ইসলাম, জুয়েল তালুকদার প্রমুখ।  তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড’র পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ডিজাইন ও পরিকল্পনার চুক্তির শর্তের ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, প্রধানমন্ত্রীর ডেলটা প্ল্যান অনুযায়ী ৬৪ জেলার অভ্যন্তরীণ ছোট নদী খাল খনন প্রকল্পের আওতায় ধানসিড়ি নদীটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ বছর মেয়াদে দুই কিস্তিতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার পুনঃখননের জন্য প্রায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটি ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান নদীর মোহনা থেকে দেড় কিলোমিটার বাদ দিয়ে খনন কাজ শুরু করা হয়। রাজাপুর উপজেলার বাগড়ি বাজারের জাঙ্গালিয়া নদীর মোহনা পর্যন্ত মোট সাড়ে ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটির ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮০৬.৫ ঘ.মি. মাটি খনন করা হবে। এ কাজের জন্য মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ কার্যাদেশ প্রদান করা হয় এবং চলতি বছরের ১২ মার্চ কাজ শুরু এবং ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল সম্পন্ন করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। কাজ সম্পন্ন না করেই বিল বকেয়া রেখেই ফেলে চলে যান ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। সরেজমিন ধানসিড়ি নদী খনন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাজাপুরের বাগড়ি বাজার ব্র্যাক এলাকা থেকে ১টি বেকুর মেশিন দিয়ে খনন কাজ চলমান রয়েছে। খনন কাজ তদারকির জন্য কাউকে দেখা যায়নি।

স্থানীয় একাধিক কৃষক ও এলাকাবাসী অভিযোগ করে জানান, ধানসিড়ি নদী খননে শুরু থেকেই দু'পাড় থেকে  বেকুর মেশিন দিয়ে মাটি ছেঁটে ও চাপিয়ে পাশে রেখে নদীতীরের উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্পের শর্তানুযায়ী নদীর উপরের চওড়া বা প্রস্থ ৭০ ফুট করার নিয়ম থাকলেও করা হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৪ ফুট। তীর বা সমতল থেকে সাড়ে ১৫ ফুট গভীর করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে করা হচ্ছে সাড়ে ১০ ফুট। তলদেশের ২০ ফুট প্রস্থও সঠিকভাবে হচ্ছে না। পাড় থেকে দূরে মাটি রাখার নিয়ম থাকলে মাটি উঠিয়ে খনন কাজের পাশে রাখার কারণে বৃষ্টিতে তা ধুয়ে পুনরায় নদীটি ভরাট হয়ে যাবে। তৃতীয়বারে এ খনন কাজ চলায় গত ২বারের খননের পরে খালের তলদেশে উপরের পাশের মাটি ধুয়ে অনেকটাই ভরে গেছে। এ ছাড়া নদীর মাঝে মাঝে বাঁধ রাখা হচ্ছে। এতে কয়েক মাসের মধ্যেই পুনরায় খননকৃত নদীটি ভরাট হয়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

এ ব্যাপারে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া না গেলেও ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী  মো. রাকিব হোসেন বলেন, ডিজাইন ও প্লান অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি চলছে। তৃতীয়বারের খননকাজে নদীটির পূর্বে স্বাভাবিক মাপ অনুযায়ী উপরের প্রস্থ ঠিক রেখে গভীর করার বিষয়টিই মুখ্য। তলদেশে গভীরতার কাজ এখনও শুরু হয়নি। শুধুমাত্র পাশের মাপ অনুযায়ী মাটি কেটে তীরে রাখছে। পরে ওই মাটি দিয়েই বেড়িবাধ দিয়ে বাকি মাটি অপসারণ করা হবে। ধানসিড়ি নদী খননে কোনো অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না এবং খননের সব শর্তের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। খনন কাজ সঠিকভাবে তদারকি করা হচ্ছে। খননের পর মেপে যেটুকু মাটি কাটা হয়েছে, সে অনুযায়ী বিল দেওয়া হবে। কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সুযোগ  নেই।

এসএ/