পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিরতা শান্তির জন্য হুমকি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিরতা শান্তির জন্য হুমকি

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এর আগে দুইবার দায়িত্বরত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়েছে। তবে সেই দুইবারই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীরা-১৯৮৯ সালে বেনজীর ভুট্টো এবং ২০০৬ সালে শওকত আজিজ দায়িত্বে থেকে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু পাকিস্তানের বর্তমান সংসদীয় সমীকরণ বলছে এই দফায় ইমরান খান বড় ধরণের পরাজয়ের সম্মুখীন হবেন এমনকি তার নিজের দলের ভেতরের ভিন্ন মতাবলম্বীরা ভোটাভুটিতে অংশগ্রহণ না করলেও। সরকার সুপ্রিম কোর্টের একটি রুলের জন্য আবেদন করেছে, যেটি বিদ্রোহ বিরোধী আইনের অধীনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের শুধু ভোট দেয়া থেকেই বিরত রাখবে না, তাদের সংসদ থেকেও আজীবন নিষিদ্ধ করবে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মিত্রদের সাথে বৈঠক করছেন, আর প্রচার করছেন যে তারা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। 

বিশ্লেষক উজাইর ইউনিস মনে করেন, ইমরান খান তার মিত্রদের সাথে সমঝোতায় ব্যর্থ হয়েছেন, এবং তিনি যদি আশ্চর্যজনকভাবে এই পরিস্থিতি উৎরে যান, তবুও তিনি যথেষ্ট অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই থাকবেন। কোনওভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যদি তিনি ক্ষমতায় টিকেও যান, তাহলে যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য তার ওপর আরও বেশি চাপ আসবে।বিশ্লেষক আবদুল বাসিতও মনে করেন যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনওভাবে ক্ষমতায় টিকে গেলেও পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে তাকে।ইমরান খানের বিরোধীরা তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের চেষ্টা করলেও দায়িত্বে থাকা অবস্থায় মি.খান তার কার্যক্রম নিয়ে কৃতিত্ব নিতেই পারেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও ইমরান খানের দল পিটিআই দরিদ্রদের মধ্যে সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

পাকিস্তানের কোভিড পরিসংখ্যানও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বেশ ভালো, যদিও এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। বাইশ কোটি জনসংখ্যার দেশে কোভিড আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন মাত্র ১৫ লাখ মানুষ, আর মৃত্যু হয়েছে ৩০ হাজারের-পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় যা খুবই কম।তবে বিশ্লেষক আরিফা নূর মনে করেন যে খাইবার পাখতুনওয়ালা ও পাঞ্জাব প্রদেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করা ছিল ইমরান খান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য।আসন্ন নির্বাচনে এটি তাদের বড় স্লোগান হতে পারে। অনেক মানুষকেই হয়তো কোভিডে তেমন ভুগতে হয়নি, কিন্তু স্বাস্থ্য কার্ডের মত একটা কর্মসূচী বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে বড় ধরণের প্রভাব রাখতে পারে। প্রশ্ন উঠছে, এ রকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মত একটি দেশে-যেখানে আজ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রী তার পাঁচ বছরের মেয়াদ সম্পন্ন করতে পারেনি-সরকার উৎখাত হলে বিরোধী দল কী প্রতিশ্রুতি দিতে পারে? তড়িঘড়ি করে গঠন করা জোটের মাধ্যমে তৈরি সরকার কি পাকিস্তানের কাঠামোগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সমাধান দিতে পারবে?বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মুহূর্তে এসব সমস্যার কোন সমাধান নেই বিরোধী দলের সামনে।পাকিস্তান আগামী অন্তত এক থেকে দেড় বছরের জন্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাবে।এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে পাকিস্তানের নাগরিকরা।পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত কিছুদিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ হলেও ইমরান খান ও বিরোধী জোটের নেতা দুজনই ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করছেন বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা ২০১৮ সালে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে পাকিস্তানকে মদিনা সনদের মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালনা করবেন তিনি। 

কিন্ত লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আলি কাসমির মতে, ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান ধর্মকে নতুন আঙ্গিকে এবং নতুন মোড়কে পাকিস্তানের রাজনীতিতে উপস্থাপন করেন। ইমরান খানের এই পন্থার সমালোচনা করলেও বিরোধী দলের জোটগুলো বাধ্য হচ্ছে তাদের রাজনীতিতে মদিনা সনদের মূলনীতি'র উল্লেখ করতে। অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও বিরোধী নেতা মাওলানা ফজলুর রহমান দুজনেই তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচনের কথা চিন্তা করেই ধর্মকে তারা ব্যবহার করছেন-কারণ এর আগের নির্বাচনে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাবাইক বিপুল ভোট পেয়েছিল।অধ্যাপক আলি কাসমি মন্তব্য করেন, 'আমরা এমন একটা বাস্তবতার মধ্যে আছি যেখানে প্রতিযোগিতা নির্ভর করবে ধর্মকে কারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারবে, তার ওপর। পাকিস্তানের রাজনীতির ধরণই এরকম, কারণ ধর্ম বাদে মানুষকে আমরা আর কিছু দিতে পারি না। পাকিস্তানে পিএমএল-এন, জেইউআই ও পিটিআই সব দলই ধর্মকে ব্যবহার করেছে।পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়লেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখনো ইমরান খানকে একটি বড় শক্তি বলেই মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম নির্মাতা লিয়াকত আলী খান এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রীদের একজন। তিনি চার বছর ২ মাস ক্ষমতায় ছিলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে মুসলিম লীগের এক জনসভায় ১৯৫১ সালে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ইমরান খানের আগ পর্যন্ত আরও ২১ জন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় এসেছেন, তবে সুবিধা করতে পারেননি কেউই। লিয়াকত আলীর পর পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন খাজা নাজিমউদ্দিন। তিনিও ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেলের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহারের পর পদ ছাড়তে বাধ্য হন। 

পরে মাত্র দুই বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলি বোগরা। অনাস্থা ভোটে তাকেও সরে যেতে হয়।এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। প্রেসিডেন্ট ও দলের নেতা ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মতের অমিলে তাকেও মাত্র এক বছরের কাছাকাছি সময়ে পদ ছাড়তে হয়।টেকেননি কেউই; এরপর একে একে এসেছেন ইব্রাহিম ইসমেইল চুনদ্রিগার, ফিরোজ খান নুন, নুরুল আমিন। তাদের প্রধানমন্ত্রিত্বের বয়স যথাক্রমে ২ মাস, ১০ মাস ও ১৩ দিন।পরবর্তীতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধে নুরুল আমিনকে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় তাকে ১৩ দিনেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়। পাকিস্তানের ক্ষমতার পালাবদলে এরপর আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন।তবে ১৯৭৭ সালেই তাকে লাহোর হাইকোর্টের দেওয়া রায় অনুযায়ী জেলে ভরা হয়। এবং ৭৯ এ প্রেসিডেন্ট জিয়া-উল-হকের ক্ষমতায় থাকাকালীন হত্যার অভিযোগে তার ফাঁসি কার্যকর হয়।এ ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ৫৮ থেকে ১৩ বছর পাকিস্তান সামরিক আইনে চলেছে। স্বাধীনতার পর থেকে যখন দেশ গঠনে একটি সুস্থ সাবলীল সরকার ব্যবস্থা একান্ত দরকার ছিল, তখন পাকিস্তান তা পায়নি। পাকিস্তানের অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রীই পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দুর্নীতি অথবা সামরিক প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে বিতণ্ডার কারণে।পাকিস্তান তাদের প্রথম গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী পায় ১৯৮৮ সালে। তিনি বেনজির ভুট্টো। তবে দুর্নীতির দায়ে তাকেও পদ ছাড়তে বাধ্য করেন প্রেসিডেন্ট গুলাম ইশক খান। এরপর আসেন নওয়াজ শরীফ। তিনিও তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খানসহ পদত্যাগ করেন।

ক্ষমতার দোলাচলে এরপরে যারা এসেছেন তাদের গতিবিধি ক্রিকেটে দুর্বল দলের ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মতোই। দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কখনো পিছু ছাড়েনি দেশটির।১৯৯৩ মঈনউদ্দিন কুরেশি সাংবিধানিক কারণে বিদায় নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন বেনজির ভুট্টোর কাছে। বেনজির এবার তার পূর্বেকার চাইতে কিছু সময় বেশি ক্ষমতায় থাকলেও আবারও প্রেসিডেন্ট ফারুক আহমাদ লেহগারির আনা দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্টদের তালিকায় পারভেজ মোশাররফ আসার পর ভোটের মাধ্যমে আবারও নির্বাচিত হন নওয়াজ। ৯৯তে এক ক্যু’র মুখে তিনিও ক্ষমতা ছাড়ার পর ইউসুফ রাজা গিলানি আসা পর্যন্ত আরও তিনজন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন আর গিয়েছেন।ইউসুফ রাজা গিলানি এসে ৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়েন। তার পরে রাজা পারভেজ আশরাফ এসে মাত্র এক বছরের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন দুর্নীতির অভিযোগে।পানামা পেপারসে নাম আসার পর নওয়াজ শরীফ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেও ১০ বছরের জন্য জেলে যান তিনি। বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রকেই নিজের দশার কারণে বারবার দায়ী করছেন ইমরান। ইমরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে যুক্তরাষ্ট্র-পিটিআই নেতাদেরও একই মন্তব্য। তারা দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র হিসেবে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আনা হয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা ও ন্যাটোকে সমর্থন না জানানোর কারণেই তার পতনের ডাক দেওয়া হয়েছে।সানডে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার বিষয়টিতে গড়িমসি করেছেন। তিনি সামরিক র‍্যাঙ্ককে পাত্তা না দিয়ে সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। পাকিস্তানি তালেবান হিসেবে পরিচিত তেহরিক-ই-তালিবানের সঙ্গে আলোচনা করা হলেও কোনো ফল আসেনি।  

পিটিআইয়ের আত্মকেন্দ্রিক ন্যায়পরায়ণতা তাদের এমন অবস্থার জন্য দায়ী বলেও মনে করেন অনেকে। জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার ঘটানোর বদলে দলটি বিষাক্ততা ছড়িয়েছে এবং ঔদ্ধত্য আচরণ দেখিয়েছে বারবার। ঔদ্ধত্য ও অভিমানের যুগলবন্দিতে পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়েছে।ইমরান খানের অনাস্থা ভোট খারিজ হওয়ার পর ৯০ দিনের ভেতর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্তে আরেকটি বিষয় ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। তা হলো-পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জাভেদ বাজওয়ার সরে যাওয়ার বিষয়টি। ইমরান আস্থা রেখেছেন আইএসআই'র সাবেক প্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল ফাইজ হামিদের ওপর। সানডে গার্ডিয়ান আরও জানায়, যদি ইমরান প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল থাকেন তাহলে জেনারেল বাজওয়াকে তার পদ থেকে সরিয়ে ফেলা হতে পারে। তার বদলে নতুন সেনাপ্রধান হতে পারেন জেনারেল হামিদ। যিনি এখন পেশওয়ারে এগারতম ব্যাটেলিয়নের প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।যাইহোক সময় ও পরিস্থিতিই বলে দেবে কোন দিকে যাবে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যত। 

লেখক: রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট।  

এসএ/