ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূচনা, আ.লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:০৮ পূর্বাহ্ন, ১লা জুলাই ২০২৫


ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সূচনা, আ.লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ
ফাইল ছবি।

বাংলাদেশে ১ জুলাই তারিখটি ইতিহাসের পাতায় এক নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে, যখন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামক একটি বৃহৎ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। শিক্ষার্থীরা সরকারের বৈষম্যমূলক কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি নিয়ে একযোগে রাজপথে নেমে আসেন, যা পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে এক অভূতপূর্ব ঝড় সৃষ্টি করে।


এই আন্দোলনটির সূচনা হয় ২০১৮ সালের হাইকোর্টের রায়ের পর, যেখানে সরকার কর্তৃক কোটা বাতিলের সরকারি প্রজ্ঞাপনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, কারণ তারা মনে করেন, কোটা পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ৫ জুনের পর থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করলেও, ১ জুলাই তা একটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়।


শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সমবেত হয়ে বিক্ষোভে অংশ নেয়, যেখানে ঢাবি থেকে শুরু করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অধীনে আন্দোলনকারীরা চার দফা দাবি জানায়: (১) সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার, (২) কোটা প্রথার মাধ্যমে মেধাবীদের প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ, (৩) সুষ্ঠু নিয়োগ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, এবং (৪) নিরাপদ পরিবেশে আন্দোলন করার অধিকার।


আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার বই ‘জুলাই: মাতৃভূমি অথবা মৃত্যু’-তে আন্দোলনের শুরু ও তার অনুভূতি নিয়ে লিখেছেন, “সেদিন বিকেলে আমি চানখারপুলে স্কুটি মেরামত করছিলাম, হঠাৎ দেখি ফেসবুকে রায় এসেছে—মনে হলো ২০১৮ সালের সব অর্জন ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।”


এরপর ৬ জুন থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা স্মারকলিপি, মানববন্ধন, ও রাস্তা অবরোধের মতো নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে।


সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়া

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার এই মন্তব্যের পর শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার…”—এমন স্লোগানে তারা প্রতিবাদ জানায়। সরকার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্টের অভিযোগ তোলে, যা আন্দোলনকে আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে।


গুম, গ্রেপ্তার ও বিভাজন

এদিকে, আন্দোলনের মধ্যে গুম এবং গ্রেপ্তার অভিযানে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৯ জুলাই আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়, এবং পুলিশ হেফাজতে থাকা ছয় সমন্বয়ক ২৮ জুলাই আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তবে আন্দোলনের আরও একাংশ দাবি করে, এটি চাপের মুখে দেওয়া হয়েছে এবং তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।


আন্দোলনের নতুন দিক

৩১ জুলাই থেকে নতুন করে ‘ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা’ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন। আগস্টের প্রথম দিকে আন্দোলনের নেতারা মুক্তি পান এবং পরবর্তী সময়ে তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেন, যা আন্দোলনের গতি ও উদ্দেশ্যকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।


এই আন্দোলনটি শুধু কোটা সংস্কারের বিষয়েই ছিল না, বরং এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকারের জন্য একত্রিত হয়ে যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


আরএক্স/