জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে: রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে উৎসব করলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:০৮ পিএম, ১লা আগস্ট ২০২৫


জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে: রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে উৎসব করলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না
ফাইল ছবি।

পারভেজ আবীর-চৌধুরী: গত বছর আজকের এই রাতটা ও ছিল সবচেয়ে অস্থির, সবচেয়ে দীর্ঘ। ৩২’শে জুলাই, গভীর রাত- একফোটা ঘুম ছিলনা চোখে। এদিক-ওদিক ফেসবুকে ঢু-মারছিলাম, কিছুতেই মনকে বসাতে পারছিলাম না। যেন এক অজানা যুদ্ধের প্রাক্কালে ছটফট করছিল পুরো শরীর। এই সেই বিপ্লব , যার নাম জুলাই বিপ্লব।


এই জুলাইয়ের প্রতিটি দিন আমরা কাটিয়েছি বুকের উপর দিয়ে, চোখে ছিল শুধুই এক নির্ভয়ের স্বপ্ন।


সেই সময় শহরের অলি-গলি থেকে উঠে এসেছিল সাহসী- ছাত্র, সাধারণ মানুষ, মায়েরা, বাবারা- সবাই মিলে গড়েছিল এক অপরাজেয় প্রতিরোধ। কেউ জীবন দিয়েছে, কেউ চোখের সামনে প্রিয়জনকে হারিয়েছে। এমনকি আমাদের মতো সাধারণ মানুষও সেদিন রাজপথে নামার আগে ভাবতাম- আজ হয়তো ঘরে ফেরা হবে না, আজ হয়তো শহীদের তালিকায় নাম উঠবে। 


এই আত্মত্যাগ আর চেতনার আগুনই বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় লিখে দিয়েছে এক নতুন অধ্যায়- রক্তিম, দগদগে আর গৌরবময়।


আজ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমরা কি আদৌ সেই বাংলাদেশে পৌঁছেছি, যে বাংলাদেশের জন্য মুক্তিকামী মানুষ বুকের তাজা রক্ত সেদিন বাংলার বুকে ঢেলে দিয়েছিল?


দুঃখজনক হলেও নির্মম সত্য- মাত্র এক বছরের মাথায় সেই রক্তাক্ত ভূমিতেই গজিয়ে উঠেছে সুবিধাবাদী কুশিলবদের নতুন উৎসব।


এ উৎসব ভোগের, ভাগের এবং নির্লজ্জ বঞ্চনার। শহীদের স্বপ্নকে তুচ্ছ করে, সেই রক্তের ওপর দাঁড়িয়েই তারা এখন বাণিজ্য করছে- ক্ষমতার এবং পদের।


এদের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত এবং বিতর্কিত ব্যক্তি - বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানি।


পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী- সবার মুখেই একটি প্রশ্ন ঘুরছে: 

এই নিয়োগের ভিত্তি কী?

কে ঠিক করলো যে তানি ‘যোগ্য’?

তার অভিজ্ঞতা কী?

চলচ্চিত্রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পসংবেদনশীল ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে কীভাবে এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বসানো হলো- যার নেই কোনো শিল্পমূল্য বোধ বা সাংস্কৃতিক ন্যূনতম চেতনা?


এই কি তবে আমাদের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ- যেখানে মেধা নয়, সুবিধা; যোগ্যতা নয়, লবিং; আর অভিজ্ঞতা নয়, তোষামোদই হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের একমাত্র মানদণ্ড?


আর সেই নিয়োগের প্রশ্নে সরকারের পক্ষ থেকে নেই কোনো ব্যাখ্যা, নেই কোনো জবাবদিহিতা। যারা গণতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তারা আজ যেন ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের প্রতিচ্ছবি- নীরব, বধির এবং বিবেকহীন।


তানির মতো একজন অযোগ্য ব্যক্তি শুধু নিয়োগই পাননি- তার আশপাশে তিনি তৈরি করেছে পরিবারতন্ত্রের বলয়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের তালিকায় দেখা যাচ্ছে- 


* প্রযোজক: সুজন মাহমুদ (নামমাত্র-পরিচিতি)

* পরিচালক: সালাউদ্দিন ইভান (উত্তর বাড্ডার স্থানীয় যুবলীগ নেতা)

* সম্পর্ক: তানির খালাতো ভাই!


চিত্রনাট্য লেখেননি, চলচ্চিত্র নির্মাণে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা নেই- তবু পেয়েছেন সরকারি অনুদান!


এটাই হচ্ছে আজকের সাংস্কৃতিক বাস্তবতা- যেখানে যোগ্যতা নয়, সুবিধা-সখ্যতাই হলো পদ পাওয়ার একমাত্র টিকেট।


অন্যদিকে, দ‍্য-‘রিমান্ড’ ছিল জুলাই চেতনার উপর সময়ের নিরিখে প্রথম নির্মিত এক সাহসী চলচ্চিত্র- সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে, কোনও সরকারি অনুদানের সহযোগিতা ছাড়াই।


এই ছবি ইতিহাসের বাস্তব দলিল হিসেবে মুখোমুখি দাঁড়াতে চেয়েছিল, আর সেজন্যই তানি ও তার সুবিধাবাদী গোষ্ঠী এটিকে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে গলা টিপে হত্যা করেছে।


প্রযোজক শুধু চেয়েছিলেন আপত্তি থাকলে জানানো হোক,

তিনি সংশোধন করে দিবেন।

কিন্তু তারা সংশোধনের পথে হাঁটেননি।

তারা চেয়েছে ছবিটাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।

কারণ তারা জানতো- ‘রিমান্ড’ মুক্তি পেলে,

বাংলার মানুষ জেগে উঠবে।


তাদের চোখে ‘রিমান্ড’ ছিল বিপজ্জনক- কারণ, সেটি ইতিহাসের কথা বলত, রক্তের গল্প বলত, আর গনতন্ত্রকামী মানুষের ঘুম ভাঙাত।


তাই তারা চায়নি ছবিটি আলোর মুখ দেখুক। কারণ, তারা চায় না মানুষ জানুক- জুলাইয়ের চেতনা কী ছিল, কারা জীবন দিয়েছিল, আর কারা আজ সেই রক্তের দামে পিঠ বাঁচিয়ে চেয়ার আঁকড়ে বসে আছে।


এটাই কি সেই বাংলাদেশ, যার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি?


সরকারের কাছে আমাদের প্রশ্ন:

১. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের মতো একটি স্পর্শকাতর, চেতনাসমৃদ্ধ স্থানে- কোনো প্রকার পাবলিক স্ক্রুটিনি ছাড়া, কোন প্রক্রিয়ায় ‘তানি’কে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসানো হলো?

২. তাঁর প্রকৃত অভিজ্ঞতা ও পেশাগত যোগ্যতা কি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে?

৩. একই গোষ্ঠীর, একই বলয়ের লোকজন কিভাবে বারবার সরকারি অনুদান পায়- এই সিন্ডিকেটের উৎস কোথায়?


আমরা ভুলে যাইনি- এই বাংলাদেশ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে কেনা।গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাই ছিল সেই আত্মত্যাগের মূল ভিত্তি।


কিন্তু আজ, সেই গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির অগ্রাধিকার হারিয়ে পরিণত হয়েছে কিছু সুবিধাবাদী, প্রভাবশালী এবং গোষ্ঠীকেন্দ্রিক লবিংয়ের হাতিয়ার।


এই পরিস্থিতি শুধু বর্তমান ‘ইন্টেরিয়াম’ সরকারের ব্যর্থতা নয়- এটি রাষ্ট্রের প্রতিটি দায়িত্বশীল স্তরের সম্মিলিত নৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা।এমন ব্যর্থতা শুধুমাত্র শাসনপ্রণালীর দুর্বলতা নয়, এটি ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা।


আমরা আজ শুধু একটি দাবি তুলছি না-  আমরা ইতিহাসের বুকে দাঁড়িয়ে এক জাতিগত প্রশ্ন তুলছি: আর কত ত্যাগ, আর কত রক্ত ঝরলে, তবেই কি ‘তানিদের’ মতো সুবিধাবাদীদের হাত থেকে মুক্তি মিলবে?


এই প্রশ্ন শুধু শাসকদের উদ্দেশে নয়, এটি সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার, বিবেকহীন নিস্তব্ধতা আর অনৈতিকতার বিরুদ্ধে একটি রক্তমাখা প্রশ্নচিহ্ন।


আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই—আমরা তানিদের বলয় থেকে চিরস্থায়ী মুক্তি চাই।

কারণ এই দেশ কোন তোষামোদকারী চক্রের নয়, এটি আমাদের রক্তে কেনা প্রিয় মাতৃভূমি।


লেখক: ব্যবসায়ী ও অভিনেতা, গুলশান, ঢাকা