দেবিদ্বারে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, ১২ শহীদের রক্তে লেখা গৌরবগাঁথা


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০২:০৫ পিএম, ৫ই আগস্ট ২০২৫


দেবিদ্বারে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’, ১২ শহীদের রক্তে লেখা গৌরবগাঁথা
ফাইল ছবি।

মো. এনামুল হক, দেবিদ্বার: ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট, কুমিল্লার দেবিদ্বার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর উত্তাপে। আন্দোলনের এই দুই দিনে পুলিশের গুলি ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীদের হামলায় প্রাণ হারান দেবিদ্বার উপজেলার অন্তত ১২ জন, আহত হন অর্ধশতাধিক। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে দেবিদ্বারের রাজপথ, ইতিহাসে যুক্ত হয় আরেকটি কালো অধ্যায়।


৪ আগস্ট: রুবেলকে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা

দিবসটির শুরুতেই বানিয়াপাড়ায় আন্দোলনে অংশ নেওয়া অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন পৌর সেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক বাদশা রুবেল (৪৩)। গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরও নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। তখন তার স্ত্রী ছিলেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বর্তমানে রুবেলের এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রয়েছে। তিনি ছিলেন দেবিদ্বার পৌরসভার বারেরা গ্রামের বাসিন্দা এবং পেশায় বাসচালক।


৫ আগস্ট: সাব্বিরের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর যাত্রা

পরদিন থানা ঘেরাওয়ের সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম সাব্বির (১৮)। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য সাব্বির ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। মৃত্যুর সঙ্গে ৪০ দিন লড়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৪ সেপ্টেম্বর। সাব্বির ছিলেন দেবিদ্বার পৌর এলাকার ভিংলাবাড়ি গ্রামের মৃত আলমগীর হোসেনের পুত্র।


আব্দুস সামাদের দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে মৃত্যু

একই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন আব্দুস সামাদ। তিনি দীর্ঘ সাত মাস ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০২৫ সালের ৪ মার্চ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মারা যান।


মানসিক ভারসাম্য হারানো আবুবকর

আহতদের মধ্যে অন্যতম স্কুলছাত্র আবুবকর, যিনি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তার পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করছেন।


দেবিদ্বারের আরও ৯ শহীদের পরিচয়

এই আন্দোলনে দেবিদ্বার উপজেলার আরও ৯ জন শহীদ হয়েছেন বিভিন্ন সময়ে ঢাকা ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:


  • ফয়সাল সরকার (২৪) – এলাহাবাদ ইউনিয়নের কাচিসাইর গ্রামের বাসিন্দা। ঢাকায় পলিটেকনিক শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯ জুলাই আব্দুল্লাহপুরে পুলিশের গুলিতে মাথা উড়ে যায়। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়।


  • সাগর মিয়া (১৯) – বড়শালঘর গ্রামের সবজি বিক্রেতা। ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।


  • হোসাইন মিয়া (১০) – বেতুয়া গ্রামের পপকর্ন বিক্রেতা। ২০ জুলাই চিটাগাং রোডে গুলিতে নিহত হন।


  • কাদির হোসেন সোহাগ (২২) – সূর্যপুর গ্রামের চাকরিজীবী। ২০ জুলাই গোপীবাগে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।


  • জহিরুল ইসলাম রাসেল – মহেশপুর গ্রামের শিক্ষার্থী। ৪ আগস্ট গুলিস্তানে নিহত হন।
  • রবিন মিয়া (৩৫) – ওয়াহেদপুর গ্রামের ব্যবসায়ী। ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়িতে নিহত হন।


  • রায়হান রাব্বি – খয়রাবাদ গ্রামের শিক্ষার্থী। ৫ আগস্ট খিলগাঁও তালতলায় নিহত হন।


  • সাইফুল ইসলাম তন্ময় – এলাহাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। (বিস্তারিত তথ্য অনুপস্থিত)


  • নাজমুল হাসান – রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা। ঢাকার বাড্ডায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন, দাফন হয় মাদারীপুরে মামার বাড়িতে।


শহীদদের স্মরণে

এই ১২ জন শহীদের আত্মত্যাগ দেবিদ্বার তথা পুরো দেশের গণআন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় কিন্তু বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়ে থাকবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এই করুণ স্মৃতি আজও বুক ফাটানো কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে তাঁদের পরিবার, সহপাঠী ও সহযোদ্ধাদের মাঝে।


আরএক্স/