গৃহবধূ থেকে যেভাবে আপসহীন নেত্রী হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৪৩ পিএম, ২৩শে আগস্ট ২০২৫

বিএনপি খালেদা জিয়া, গৃহবধূ থেকে আপসহীন এক নেত্রীর নাম। তার আপসহীন সংগ্রামী মনোভাব বাংলাদেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে বারবার লড়াইয়ের পথ দেখিয়েছে। সাধারণ একজন গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে এক অপ্রতিরোধ্য নেতৃত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধুমাত্র সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধেই নয়, পরবর্তীতে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনার কালো ছায়া থেকে বাংলাদেশকে নিরাপদে রাখতে তার ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় এই নেত্রী ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা চন্দনবাড়ির মেয়ে তৈয়বা মজুমদার আর পিতা ফেনীর ফুলগাজির ইস্কান্দার মজুমদার।
দিনাজপুরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। জিয়া-খালেদা দম্পতির দুই সন্তান বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মরহুম আরাফাত রহমান কোকো।
১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তার আগ পর্যন্ত সাধারণ গৃহবধূই ছিলেন খালেদা জিয়া।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের নেতাদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। তখন তড়িঘড়ি করে ৭৮ বছর বয়সী ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত, খালেদা জিয়াকে নিয়ে সামরিক ও শাসকচক্রের জন্য ভয় থাকায় তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ চেয়েছিলেন, সাত্তার প্রেসিডেন্ট হোক। এ নিয়ে সেসময় বিএনপিতে মতভেদও দেখা দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জামায়াতের আলোচনা, যা জানা গেল
কিন্তু বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বয়স এবং দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। এমন অবস্থায় বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তখনও রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। তবে, দলের নেতাকর্মীরা দিনের পরদিন খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আসার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না বলেও অনেকে বলেন।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়ে এরশাদের মনে ভয় ছিল। কারণ এরশাদ তখন ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করছিলেন, ভাবছিলেন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এলে পরিস্থিতি সামলানো তার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
কিন্তু কোনো বাধাই আর কাজে আসল না। অবশেষে দলের নেতাকর্মীদের অনুরোধে রাজপথে নামেন খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ১৩ জানুয়ারি কর্মী হিসেবে রাজনীতিতে নাম লিখান তিনি। এরপর বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া শুরু করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন।
দলের তরুণ অংশ খালেদা জিয়াকে দলীয় প্রধান হিসেবে দেখতে চাইলেও জেনারেল এরশাদ আগ্রহ ছিল আব্দুস সাত্তার। বিএনপির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য একইসঙ্গে প্রার্থী হয়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। এর ফলে এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়।
সেসময় বিচারপতি সাত্তার খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে দলের সহ-সভাপতি এবং ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করেননি। অবশেষে সাত্তারের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর খালেদা জিয়া চেয়ারম্যান পদ থেকে তার প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সাত্তার তখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির চেয়ারম্যান থাকলেও দল পরিচালনায় খালেদা জিয়ার প্রভাব বাড়তে থাকে।
১৯৮৩ সালের মার্চে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন। এর কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৪ সালের ১০মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
আরও পড়ুন: বিএনপি চেয়ারপার্সনের খোঁজ নিতে ফিরোজায় যাবেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
একদিকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছিল, অন্যদিকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। তিনি হয়ে উঠেন আপসহীন নেত্রী। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে।
রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রথম মেয়াদ ছিল ১৯৯১-৯৬, দ্বিতীয় মেয়াদ ছিল ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির পর কয়েক সপ্তাহ এবং তৃতীয় মেয়াদ ছিল ২০০১-২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নিয়ে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে আর ঘুরে দাঁড়াতে দেয়নি। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন খালেদা জিয়া। শুরুটা ২০১০ সালে; এক কাপড়ে জোর করে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার মাধ্যমে।
সেসময় বেগম জিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, বেড রুমের দরজা ভেঙে টেনে-হিঁচড়ে তার কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমাকে অপমান করা হয়েছে। যেভাবে বের করা হয়েছে, তাতে আমি লজ্জিত।
সেনানিবাসের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে বের করে দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একে একে মিথ্যা মামলা দিতে থাকে আওয়ামী সরকার। এরমধ্যে ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মামলাগুলোকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে শেখ হাসিনা।
শুধু তাই নয়, বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত করা হয়। যার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারেননি। এরপর খালেদা জিয়াকে ‘সাজানো মামলার ফরমায়েশি’ রায়ে কারারুদ্ধ করে শেখ হাসিনার সরকার।
পুরোনো কারাগারে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিনা চিকিৎসায় বন্দি রাখার ফলে বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে স্লো পয়জনিং করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বেগম জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করলেও বারবার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদন শেখ হাসিনার সরকার নাকচ করে দেয়।
এরপর দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হলে, বাধ্য হয়ে সাজা স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বেগম খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয় সরকার। এ সময় গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় বন্দী রাখা হয় বেগম জিয়াকে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের অবৈধ নির্বাচন ও শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার শর্তে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল আওয়ামী সরকার। এজন্য তাকে রাজি করাতে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু দেশের গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে এবং মানুষের স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়া সেই প্রস্তাবে আপসহীন এই নেত্রীকে রাজি করাতে পারেনি কেউ।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা যা চাচ্ছেন, পিআর পদ্ধতি অনেকটা সেইরকম: রিজভী
এরমধ্যে ২০২৪ সালের জুলাইতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত সরকার পতনের আন্দোলনে গড়ায়। টানা ৩৫ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে পর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি লন্ডনে যান। দীর্ঘ চার মাসের চিকিৎসা শেষে ৬ মে দেশে ফিরেন আপসহীন এই নেত্রী।
এমএল/
বিজ্ঞাপন
পাঠকপ্রিয়
আরও পড়ুন

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে জামায়াতের আলোচনা, যা জানা গেল

বিএনপি চেয়ারপার্সনের খোঁজ নিতে ফিরোজায় যাবেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী

শেখ হাসিনা যা চাচ্ছেন, পিআর পদ্ধতি অনেকটা সেইরকম: রিজভী

পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাই এখন দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে: মির্জা ফখরুল
