দৈন্যদশা ও ভোগান্তির আরেক নাম ঢাকা নিম্ন আদালত, ঢাকা কোর্টের ইটেও ঘুষ খায়


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


দৈন্যদশা ও ভোগান্তির আরেক নাম ঢাকা নিম্ন আদালত, ঢাকা কোর্টের ইটেও ঘুষ খায়

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মনস্থ গতি থেকেই দুর্নীতির জন্ম বললে ভুল হবে না, দেশের ১৩টি সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগে সবচেয়ে বেশি হয়রানি, অনিয়ম, ঘুষ দেয়া তথা দুর্নীতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঢাকা নিম্ন আদালতে বিচারপ্রার্থীদের সাথে কথা বললেই এর প্রমান পাওয়া যায়। এমনও কথা প্রচলিত আছে যে, নিম্ন আদালতের (ঢাকা কোর্ট) ইট পর্যন্ত ঘুষ খায়।

দৈন্যদশা ও ভোগান্তির আরেক নাম ঢাকা নিম্ন আদালত। দেশের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মামলা বিচারাধীন রয়েছে ঢাকার এই আদালতে। কিন্তু এই আদালতের ব্যবস্থাপনা বিচারপ্রার্থী বান্ধব হয়ে ওঠেনি এখনও পর্যন্ত। আদালতের দৈন্যদশা ও বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে যেমন- মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেয়া, ওকালতনামায় স্বাক্ষর করা, জামিননামা দেওয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল এগিয়ে আনা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো সেবায় ইত্যাদি। এছাড়ও পত্রিকাতে পলাতক আসামীর বিজ্ঞপ্তি , নিলাম ও জারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশেও সাংবাদ পত্রের বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিদের থেকেও বকশিশ বা খরচাপাতির নামে নেওয়া হয় ঘুষ। আর এই ঘুষ ছাড়া যেন কোন কাজই হয় না ঢাকা কোর্টে।

বকশিশ বা ঘুষের পরিমান সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে দুই থেকে দশ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়, ক্ষেত্রবিশেষ লাখ টাকাও গুনতে হয় ভুক্তভোগীদের। এতে নিন্ম আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীদের হতে হয় পদে পদে চরম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার। এ যেন দেখার কেউ নেই। যুগের পর যুগ বকশিশ আর ঘুষ বাণিজ্যে আটকে আছেন বিচারপ্রার্থীরা। বকশিশ ছাড়া মেলে না কোন সেবা, নড়ে না মামলার ফাইলও। ফলে বাধ্য হয়েই গুনতে হচ্ছে টাকা।

শুধু কি বকশিশ! ঘুষ বাণিজ্য এছাড়াও দালাল আর পুলিশের দৌরাত্ম্যে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকে। অভিযোগ আছে, পুলিশ ও দালালদের এসব বেআইনি কাজেও সহযোগিতা করে কোর্টের এক শ্রেণীর কর্মচারী। আবার এক শ্রেণীর চক্র আছে যারা বিভিন্ন মামলার সাক্ষী যোগাড় করে দেয়। জামিন করে দেয়ার নামে টাকা আত্মসাৎ করাই এদের পেশা। এ কাজে তাদের সহযোগী বিভিন্ন কোর্টের কর্মচারী, মহুরি এমনকি কিছু আইনজীবী। দালালদের উচ্ছেদে ঢাকা বার সমিতি মাঝে মাঝে কিছু ব্যবস্থা নিলেও পুলিশের দুর্নীতি চলে প্রকাশ্যেই। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই দেখা যায় ঘুষ দিতে এবং নিতে। 

এই খরচ সামালদিতে গিয়ে কেউ কেউ হচ্ছেন নিঃস্ব, কেউ মামলা চালাতে গিয়ে বিক্রি করছেন জমি-জয়গা। তবে বিচারপ্রার্থীরা নিঃস্ব হলেও অর্থ-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে উঠছে আদালত কেন্দ্রিক দালাল ও পেশাজীবী শ্রেণি। কেউ কেউ গড়ছেন আলিশান অট্টালিকাও। আইন আদালতের বিষয়ে বহুকাল থেকে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে ‘আদালতের ইটেও ঘুষ খায়’। বাস্তবেও তার দেখা মেলে ঢাকার নিম্ন আদালতে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিন্ম আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, ইষ্টেনোগ্রাফার (আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর), বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেসপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়মের সাথে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। আদালতে দেওয়া ঘুষের এই টাকাকে তারা বলে খরচাপাতি। তবে ঘুষের এই খরচাপাতিকে আদালতের উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ কেউই ‘ঘুষ’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য নির্বিঘেœ কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয়।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকার আদালতে প্রায় সাড়ে চার লাখের উপরে ফৌজদারি ও দেড় লাখ দেওয়ানী মামলা বিচারধীন রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় আদালত চলার দিনগুলোতে প্রতিদিন প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বা তার থেকে বেশি বিচারপ্রার্থী বিচরণ করে এই আদালত পাড়ায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটু বসা বা রেস্ট নেওয়ার জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। নেই পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত টয়লেট ব্যবস্থা। সুউচ্চ ভবনে উঠার জন্য নেই পর্যাপ্ত লিফট। গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নেই কোনো জায়গা। সব মিলিয়ে ঢাকা নিম্ন আদালতে আসা বিচার প্রার্থীদের দৈন্যদশা ও ভোগান্তির যেন শেষ নেই।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঢাকা জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ, সিএমএম ও চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রায় সব আদালতেই আদেশ লিখে সংশ্লিষ্ট আদালতের পিয়ন, পেশকার, উমেদার, জিআর সেকশনের কনস্টেবল এবং জিআরও। পরে সেসব লিখিত আদেশের নিচে বিচারক কেবল স্বাক্ষর করেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো কোনো মামলার ক্ষেত্রে শুনানির পূর্বে বিচারকের জন্য শুধু আদেশই লিখে রাখে না পরবর্তী তারিখও ধার্য করে দেয় ওইসব পিয়ন, পেশকার, উমেদার এবং জিআরও সেকশনের কনস্টেবলরা। সংশ্লিষ্ট মামলার অভিযোগে বা আরজিতে কোথায় কী আইনগত ফাঁক আছে, আইনজীবী শুনানিতে কী বলবে এবং বিচারক ওই বিষয়ে কী আদেশ দিবে তা কীভাবে ওইসব পিয়ন, পেশকার ও কনস্টেবলরা আগে থেকেই জানে তা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার।

মূলত এ বিস্ময়ের মাঝেই লুকিয়ে আছে দুর্নীতির আসল রহস্য। বিভিন্ন আাদালত ও জিআর সেকশনে ঘুরে এই একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। আর এজন্যই আইনজীবী থেকে শুরু করে বিচারপ্রার্থীরা এসব অঘোষিত ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তোয়াজ করে চলে। নানাভাবে তাদেরকে রাজি-খুশি করার চেষ্টা করে সবাই। কারণ তাদের কলমের খোঁচাতেই হতে পারে বড় কোনো লাভ বা ক্ষতি। 

এসব বেআইনি কাজের কথা সবই জানে ওইসব আদালতের বিচারকরা। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যেন সুযোগটা তারাই দিয়ে রেখেছে। এতে সুবিধা হলো কাজের চাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়। আরও যেসব সুবিধার কথা শোনা যায় দুষ্টলোকদের সেসব কথার দিকে কান না দেয়াই ভালো।
পিয়ন, পেশকার, উমেদার ও কনস্টেবলদের আছে অত্যন্ত শক্তিশালী আন্তঃআদালত নেটওয়ার্ক। ফলে সব আদালতের চিত্রই একরকম। এমনকি তারা অর্থের বিনিময়ে পক্ষদের নথি গুম করে রাখে। নথি খুঁজে না পাওয়ায় অনেকে নারাজী দাখিল কিংবা রিভিশন বা রিভিউ আবেদন করতে পারেন না। একপক্ষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্যপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই এসব করা হয়ে থাকে।

আবার কখনও পক্ষদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তারা হাজির আছে মর্মে নথিতে উল্লেখ করে দেয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নথি থেকে সময়ের আবেদন সরিয়ে ফেলে হাজিরা দেখিয়ে দেয় আদেশের মধ্যে।

এছাড়া ভুয়া বাদী সাজিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলায় আইনজীবীর বিকৃত সিল দেয়া, হাজিরা, ওকালতনামা ও পিটিশন গ্রহণ করা, এমনকি আসামি বদল করে অন্য আসামি দিয়ে জেল খাটানোর নজিরও আছে ঢাকার নিম্ন আদালতে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আইনজীবী বলেন, ‘মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে অবৈধ খরচাপাতি ঘুষ বাণিজ্য, যার সবটাই বহন করতে হয় বিচারপ্রার্থীকে। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালিসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। এটা চরম দুর্নীতি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও বিজ্ঞাপন প্রতিনিধির বক্তব্য, ‘আসলে বকশিশ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অবৈধ। বকশিশ দেওয়া- নেওয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তবুও এ বিষয়টি আদালতপাড়ায় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। আদালত থেকে পত্রিকায় যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় সেটা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের মোটা অংকের টাকা দিতে হয়, টাকা ছাড়া কোন পত্রিকাতেই তারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ লেখে না। ঢাকাতে চারটি অর্থঋণ আদালত রয়েছে সেখানে নিয়মিত পত্রিকা বিজ্ঞপ্তির আদেশ হয় যারা আদালতের পিয়ন, পেশকার, সেরেস্তাদারকে ম্যানেজ করতে পারে তারাই বিজ্ঞপ্তি পাই। এছাড়াও মহানগর নেজারত বিভাগ, সিএমএম নেজারত বিভাগ, সিজেএম নেজারত বিভাগ, নারী ও শিশু (১ থেকে ৯) ইষ্টেনোগ্রাফার থেকে সরকারী বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রেও মোটা অংকের টাকা দিতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আইন ও বিচার বিভাগে বকশিশ প্রক্রিয়াটি বৃটিশ আমল থেকে প্রচলিত। তবে কেউ যদি জোড় করে বকশিশ ও খরচাপাতির নামে ঘুষ নেই তাহলে সেটা অবৈধ।

আদালতকে শেষ আশ্রয়স্থল ভেবে বিচারপ্রার্থীরা যে একটু আশার আলো দেখে তা কিছু সংখ্যক অসাধু লোকের জন্য নষ্ট হচ্ছে। এমন করুণ বাস্তবতা একটি সফল রাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি। রাষ্ট্র ও আদালত উভয় প্রতিষ্ঠানের উচিত আদালতের মর্যাদা সবার সামনে প্রতিষ্ঠিত করা। সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত সেখানে এমন দুর্নীতি, দৈন্যদশা, ভোগান্তি, ঘুষবাণিজ্য দেখার যেন কেউ নেই।