দলে দলে বিভক্ত জেন-জিরা, সেনাবাহিনীর টানাপোড়েন কোন পথে নেপাল?
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯:৪৭ পিএম, ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৫

নেপালে জেন-জিদের কঠোর আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগের পর দেশের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। দেশটিতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হলেও কোনও সমাধানে পৌঁছাতে পারেননি জেন-জি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, নেপাল সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জেন-জি আন্দোলনকারীরা। তাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনী সঙ্কটকালীন আলোচনায় দেশটির বিতর্কিত চিকিৎসা উদ্যোক্তা দুর্গা প্রসাইকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) দিনভর আলোচনার পরও সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল বার বার প্রসাইকে আলোচনার অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে জোর দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তরুণ আন্দোলনকারীরা আলোচনা থেকে বেরিয়ে যান।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, তারা এখন কেবল প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেলের সঙ্গেই সরাসরি আলোচনা করতে চান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আন্দোলনকারী বলেন, সেনাবাহিনী সমন্বয় করায় আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম। কিন্তু তারা আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের অযথা গুরুত্ব দিয়েছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আলোচনা কেবল রাষ্ট্রপতির সঙ্গেই হবে।
দেশটির জেন-জি আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট পাউডেলকে কেবল বিবৃতিতে নয়, বরং রাজনৈতিক সমাধান খোঁজায় সক্রিয় ভূমিকা রাখার দাবি জানিয়েছেন। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে তারা আবারও বিক্ষোভ শুরু করবেন। এছাড়া দ্রুত এই সঙ্কটের অবসানে তাৎক্ষণিক সত্যাগ্রহ (অহিংস প্রতিরোধ) কর্মসূচির প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
আরও পড়ুন: কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সর্বোচ্চ ধনীর খেতাব ফিরে পেলেন ইলন মাস্ক
নেপালের গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিক্ষোভকারীরা সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং দুর্নীতি-বিরোধী কর্মী সুশীলা কার্কিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বের জন্য বেছে নিয়েছেন। অস্থায়ীভাবে দেশ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন কার্কি।
দেশটির সাবেক এই নারী প্রধান বিচারপতির মনোনয়নে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। সুজিত কুমার ঝা নামের এক আন্দোলনকারী ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘আমরা সুশীলা কার্কিকে সৎ এবং নির্ভীক হিসেবে দেখি। তিনি আমাদের সঠিক পছন্দ। যখন সত্য কথা বলে, তখন তা কার্কির কণ্ঠস্বরের মতো শোনায়।
জুনাল গাদাল নামের আরেক বিক্ষোভকারী নেপালি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমাদের উচিত সুশীলা কার্কিকে বেছে নেওয়া; যিনি দেশের অভিভাবক হিসেবে সেরা বিকল্প। বিক্ষোভকারী ওজাস্বী বলেন, আমরা চাই সুশীলা কার্কি প্রধানমন্ত্রী হন; এমনকি যদি তা অস্থায়ী নিয়োগও হয়। আমাদের দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়টি সুন্দর হবে। আমরা তাকে বেছে নিতে চাই, কারণ তিনি আমাদের এই দেশ গড়তে সাহায্য করতে পারেন।
এদিকে, কার্কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে... তারা এখন অচল হয়ে গেছে।’’
আরও পড়ুন: ইন্দোনেশিয়ায় আকস্মিক বন্যায় ১৪ জনের মৃত্যু
জেন-জিদের একাংশ বিবৃতি দিয়ে প্রকৌশলী কুলমান ঘিসিংকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটিতে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে এই প্রকৌশলীর।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘৭৩ বছর বয়সী সাবেক প্রধান বিচারপতি কার্কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব নিতে পারবেন না। কারণ সংবিধানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের বিচার বিভাগের বাইরে কোনও পদে দায়িত্ব গ্রহণের বিধান নেই। এছাড়া জেন-জি নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ‘অত্যধিক বয়স্ক’।
ঘিসিংকে ‘দেশপ্রেমিক’ এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য ‘সবার প্রিয়’ প্রার্থী হিসেবে বিবৃতিতে বর্ণনা করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের এই মতপার্থক্য ঘিরে বৃহস্পতিবার বিকেলে কাঠমান্ডুতে তাদের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
কার্কি ও সাংবিধানিক জটিলতা
নেপালের সংবিধানের একটি ধারা আছে, যা ২০১৫ সালে কার্যকর হয়। নেপালের ২৩৯ বছরের পুরোনো হিন্দু রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার সাত বছর পর প্রণীত হয় ওই ধারা। সংবিধানের এই ধারাকে কার্কির অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বাধা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে সূত্র বলছে, সাংবিধানিক এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।
দেশটির বেশিরভাগ আন্দোলনকারী কার্কির পক্ষে রয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি রাম চন্দ্র পাওডেলের বক্তব্যেও তার ইঙ্গিত মিলেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি সংবিধানের মধ্যে থেকেই দেশের বর্তমান কঠিন পরিস্থিতির সমাধান খুঁজে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমি সব পক্ষকে আশ্বস্ত করছি... শিগগিরই সমাধান বের করার চেষ্টা চলছে; যাতে আন্দোলনরত নাগরিকদের দাবি পূরণ করা যায়।’’
এদিকে, বিক্ষোভকারীদের শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল। আর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন কার্কি।
আরও পড়ুন: তিন দশকের লুটের বিচার, নতুন সংবিধান চায় নেপালের তরুণরা
ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রার্থী?
ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে উঠে আসছে কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহর নাম। জেন-জি প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে ৩৫ বছর বয়সী এই প্রকৌশলীর। দেশটিতে র্যাপার-রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত তিনি।
তবে শাহ দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালের দিকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সুশীলা কার্কির প্রতি সমর্থন জানান তিনি।
বালেন্দ্র শাহ বলেন, ‘‘এখন আতঙ্কিত হবেন না, ধৈর্য্য ধরুন। দেশ একটি অন্তর্বর্তী সরকার পেতে যাচ্ছে। এর কাজ হবে নির্বাচন আয়োজন করা; যা দেশে নতুন ম্যান্ডেট দেবে।’’
চতুর্থ বিকল্প?
আন্দোলনকারীদের আরেক অংশ দেশটির ধারান প্রদেশের দু’বারের নির্বাচিত মেয়র, সমাজসেবক ও দুর্নীতি-বিরোধী কর্মী হার্কা সাম্পাংয়ের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। তবে সাম্পাংয়ের ওপর থেকে সমর্থন খুব দ্রুতই প্রত্যাহার করে নেন তারা। ঘিসিং-সমর্থিত জেন-জিরা বলেছেন, দেশ পরিচালনার জন্য হার্কা সাম্পাং উপযুক্ত ব্যক্তি নন।
অন্তর্বর্তী সরকার?
দেশটিতে সম্ভাব্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো এখনও পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে দেশটির সংবিধানে অস্থায়ী প্রশাসনের কোনও উল্লেখ না থাকায় এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। নেপালের সংবিধান অনুযায়ী, নতুন প্রধানমন্ত্রীকে এমন দল (বা জোট) থেকে আসতে হবে; যার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এটি কার্কি বা ঘিসিংয়ের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
যদি কোনও বিকল্প না পাওয়া যায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট নিজেই উত্তরসূরি মনোনীত করতে পারেন কিংবা যে কোনও সংসদ সদস্য এগিয়ে এসে আস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে পারেন। তিনি আস্থা ভোটে ব্যর্থ হলে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে এবং দেশে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। কারণ দেশটির পুরোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন কার্যত আড়ালে চলে গেছে। নেপালের চারবারের প্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির অভিজ্ঞ নেতা অলির অবস্থান এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তার সাবেক জোটসঙ্গী ও পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী, নেপালি কংগ্রেস প্রধান শের বাহাদুর দেউবাও নিখোঁজ রয়েছেন।
দেশটির গণমাধ্যম বলছে, তারা ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু জনরোষের কারণে বর্তমানে দুজনই অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন।
সংবিধান পরিবর্তন চাই না
কার্কি-সমর্থক জেন-জি আন্দোলনকারীরা বলেছেন, সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনা তাদের কোনও লক্ষ্য নয়। অনিল বানিয়া নামের এক আন্দোলনকারী নেতা বলেন, ‘‘অনলাইন জরিপের মাধ্যমে আমরা সুশীলা কার্কিকে ভোট দিয়েছি। আমরা সংবিধান পরিবর্তন করতে চাই না... শুধু প্রয়োজনীয় সংশোধনী চাই, যা কার্কিকে অস্থায়ী শপথ নেওয়ার অনুমতি দেবে।’’
আরও পড়ুন: ফ্রান্সে নতুন সরকারের প্রথম দিনেই বিক্ষোভে উত্তাল
দীবাকর দাঙ্গাল নামের আরেকজন বিক্ষোভকারী বলেন, আমাদের আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। আমরা এখনও দেশের নেতৃত্ব গ্রহণের মতো যোগ্য নই। তিনি বলেন, ‘‘আমরা সংসদ ভাঙতে চাই, কিন্তু সংবিধান বাতিল করতে চাই না।’’
দাঙ্গাল বলেন, নেপালের অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপ্রধান কে হবেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, জেন-জি আন্দোলনকারীদের অভিন্ন লক্ষ্য কেবল পরিবর্তন; পুরোপুরি পরিবর্তন।
রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই রক্তপাত আপনাদের কারণে হয়েছে। সমালোচকদের সতর্ক করে দাঙ্গাল বলেন, আবার যদি আমরা রক্তপাত শুরু করি, তাহলে আপনারা বাঁচতে পারবেন না।’’
অন্যদিকে, দেশটির রাজধানীতে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহল দিচ্ছেন। শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদেরও দেশজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে।
নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার (০৮ সেপ্টেম্বর) সকালের দিকে বিক্ষোভ শুরু করেন দেশটির হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। মঙ্গলবার (০৯ সেপ্টেম্বর) সেই বিক্ষোভ ব্যাপক সহিংস আকার ধারণ করে এবং প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য জন। দেশটিতে দুদিনের সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩১ জন নিহত ও ১ হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবন ও ঐতিহাসিক সিংহ দরবারে হামলা ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেন।
এমএল/