করোনা মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির সকল সূচকে ঊর্ধমুখী অর্জনে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি শিল্পকারখানা, ব্যাবসাবাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন, উৎপাদন কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার হয়েছে। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের রিপোর্টেও তার প্রতিফলন দৃশ্যমান। ভারত পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক শক্তিশালী দেশকে পেছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। করোনায় বিশ্বঅর্থনীতির অবস্থানে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের ধারা চলছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশটি হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিক এন্ড বিজনেস রিসার্চ তাদের সর্বশেষ এক রিপোর্টে এই পূর্বাভাস দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ প্রায় সবকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাম্প্রতিক রিপোর্টে করোনা মহামারির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ,অর্থনীতি ও মানুষের জীবন সচল রাখার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মানুষকে কর্মমুখী রাখা সম্ভব হয়েছে। মূলত রেমিটেন্স, রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, মাথাপিছু গড় আয়, গড় আয়ু, নারী ও শিশুমৃত্যু হার হ্রাস, সকলের জন্য বিদ্যুৎ, শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে।
করোনাকালে মানুষের জীবন ও জীবিকার চাকা সচল এবং অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম দফায় ৭২ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনায় মূলত করোনাকালেও অর্থনীতকে সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি করোনা নিয়ন্ত্রণে শুরু থেকে টিকা সংগ্রহ, মানুষকে সচেতন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ায় পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেক কম ছিল। পাশাপাশি কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমায় দীর্ঘ লকডাউন শেষে ঘরবন্দি মানুষ বাইরে বের হতে শুরু করলে বাড়ছে কেনাকাটা ও ব্যাবসাবাণিজ্যের কর্মকাণ্ডেও ফিরছে গতি; ইতিবাচক সূচক অব্যাহত দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। করোনাভীতি কাটিয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ায়। বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা বাড়াচ্ছে রপ্তানি আয়। এতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হচ্ছে আমদানিতে। ব্যাবসাবাণিজ্য বাড়ায় সরকারের রাজস্ব আহরণও বাড়তে শুরু করেছে।
কোভিড-১৯ এর কারণে থমকে যাওয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সম্ভাবনা বাড়ছে, ঝুলে থাকা শূন্যপদে শুরু হয়েছে নিয়োগ। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যাশিত না হলেও এখাতে মহামারির স্থবিরতা কাটবে বলে আশায় রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে যাওয়ার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারাও। আমদানি-রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ও অর্থনীতির অন্যান্য সূচক বিশ্লেষণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালকের অভিমত অনুযায়ী কোভিডের অচলাবস্থা ভেঙে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বস্তিকর গতি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এবং উৎপাদন পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে না গেলেও কাছাকাছি পর্যায়ে গেছে। এটা একটা ইতিবাচক পর্যায়ে যাচ্ছে। আগামী বছরের প্রথম ৩/৪ মাসের মধ্যে হয়তো আমরা কোভিডের বিরূপ প্রভাব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারবো।’’
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে আমদানিতে এক হাজার ২৬৭ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে যা বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৮৭৩ কোটি ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রথম চার মাস শেষে রপ্তানি আয়ে ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে মোট রপ্তানি হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি। আমদানি-রপ্তানিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসার এমন পরিস্থিতিতে ব্যাবসাবাণিজ্যের বিদ্যমান ঝুঁকিগুলো কমিয়ে এনে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা।
আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি-ফিচ সম্প্রতি বাংলাদেশের রেটিং আগের মতো ‘বিবি মাইনাস’ বজায় রেখেছে। গত ৮ নভেম্বর প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের কোভিড পূর্ববর্তী প্রবৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরে মহামারি পরবর্তী সময়ে জিডিপি অনেক ভালো হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আগামী বছর ২০২২ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা ৭ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে আভাস প্রতিষ্ঠানটির। অগাস্টের পর থেকে দৈনিক শনাক্তের পরিমাণ কমেছে এবং টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে নিতে টিকা সরবরাহের যে ঘাটতি ছিল তা পূরণ হতে শুরু করেছে। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ পুরোপুরি টিকার আওতায় এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে তৈরি পোশাক রপ্তানি ২০২০ সালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমলেও এখন তা ভালোভাবেই পুনরুদ্ধার হতে শুরু করেছে।
এসময়ে সরকারের বড়ো প্রকল্পগুলোও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই ৩/৪টা বড়ো বড়ো প্রকল্প চূড়ান্তভাবে শেষ হবে। এগুলো বড়ো প্রকল্প, এগুলোর ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে। আমদানি-রপ্তানির উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হলেও আমদানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫০ কোটি ৩০ লাখ (৬.৫ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে তা তিন গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এর নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের মতে দেশে কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশ গতিশীল হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কোভিডের মধ্যেও বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ। শুধু পোশাকখাতের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। অর্থমূল্যের হিসেবে এ সময়ে ৪৮৪ কোটি ডলার সমমূল্যের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, যা গতবছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ২৮৭ কোটি ডলার। শিল্পপণ্যের মধ্যে সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানি হয়েছে ২৪ কোটি ডলার, যা আগের বছর ছিল ১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২২ শতাংশ। তৈল বীজ আমদানি হয়েছে ২৯ কোটি ডলার যা আগের বছর একই সময়ে ছিল ২৬ কোটি ডলার; প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ।
আমদানি পণ্যের মধ্যে রাসায়নিক দ্রব্য এসেছে ৮৫ কোটি ৩০ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৭২ কোটি ৭০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। প্লাস্টিক ও রাবার পণ্যের কাঁচামাল এসেছে প্রায় ৯৫ কোটি ডলার; প্রবৃদ্ধি ৫৩ শতাংশ। আয়রন, স্টিল ও অন্যান্য ধাতব পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ১৬৬ কোটি ৯ লাখ ডলারের যা আগের বছর একই প্রান্তিকে ছিল মাত্র ৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি ৭৪ শতাংশ।
এছাড়া শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মূলধনি পণ্য আমদানিতেও হয়েছে ৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এ তিন মাসে ৩৬৯ কোটি ডলার সমমূল্যের মূলধনি পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ২৬৩ কোটি ডলার। শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল- ইপিজেডগুলোর জন্য বিশেষভাবে আমদানি হয়েছে ১১০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পণ্য, গত অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে এসেছিল মাত্র ৬৯ কোটি ৪০ লাখ।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রপ্তানিতেও অর্থবছরের প্রথম চার মাসে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে রেকর্ড পণ্য রপ্তানির পর অক্টোবরেও তা আরও বেড়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকায় ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে রপ্তানিখাত। ইপিবির তথ্য বলছে, অক্টোবরে ৪৭২ কোটি ৭০ লাখ ৫০ হাজার ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালের অক্টোবরে আয় এসেছিল ২৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরেও একক মাসে রেকর্ড পরিমাণ ৪১৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসশেষে রপ্তানি আয় হয়েছে এক হাজার ৫৭৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চাঙা হওয়ায় কর্মসংস্থানের বন্ধ দুয়ারও খুলছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। অধিকাংশ কারখানাতেই নতুন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে থেমে থাকা সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়াও চালু হয়েছে। রপ্তানিকারকদের মতে, পোশাকখাতে ক্রয়াদেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতে নতুন দক্ষকর্মীরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ বড়ো কারখানায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শ্রমিকের চাহিদা তৈরি হয়েছে। এ হিসেবে এ খাতে নতুন করে আরও তিন লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।
লেখক: মোতাহার হোসেন, সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জা জার্নালিস্ট ফোরাম পিআইডি ফিচার