আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার কণ্ঠস্বর ইমরান খান


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার কণ্ঠস্বর ইমরান খান

খান অভিযোগ করেন, তিনি পাকিস্তানে "শাসন পরিবর্তন" প্রভাবিত করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার শিকার। কারণ তার পররাষ্ট্র নীতিতে পশ্চিমা বিরোধীতা আছে, যা আফগানিস্তানে আমেরিকার যুদ্ধের সমালোচনাও আছে। খান বলেন, আমেরিকা সবসময় পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে, আর চীন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা তার কৌশলগত লক্ষ্য পূরণের জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছে, উদ্দেশ্য পূরণ হলে পাবিস্তানকে পরিত্যাগ এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। খান রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিলেন। রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাচ্ছে তখন ইমরান খান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে মস্কো যান। ইমরানের রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা খুশি হন নি। ইরানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারস্য উপসাগরীয় মিত্রদের সাথে কাজ করার পাকিস্তানের ইতিহাস রয়েছে। ইমরান খান সেই পথ থেকে বিচ্যুত হন এবং তেহরানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন বিদেশী শক্তিগুলো তাকে পছন্দ করেনি, কারণ "কারো কাছ থেকে হুকুম না নেওয়া" তার মনোভাব।

ইমরান খান ভারতের পররাষ্ট্র নীতির প্রশংসা করেছেন। “হিন্দুস্তানের পররাষ্ট্রনীতি জনগণের জন্য। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কীভাবে অন্যদের (মার্কিন) জন্য হতে পারে,” তিনি প্রশ্ন তোলেন। "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি না করতে বলেছিল, কিন্তু নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনকে বলেছিল যে মস্কো থেকে পণ্য কেনা তাদের দেশের স্বার্থে।" তিনি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ভারতীয়দের খুদ্দার কওম (সম্মানিত ব্যক্তি) বলে অভিহিত করেছিলেন, যাদেরকে কেউ শর্ত দিতে পারে না।

খান বলেছেন তার রাশিয়া সফর পাকিস্তানের "সর্বোত্তম স্বার্থে"। "আমি গ্যাস, তেল এবং গমের জন্য রাশিয়া গিয়েছিলাম কারণ আমি ভেবেছিলাম এটি আমার লোকদের উপকার করবে এবং আমি মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারব," । তিনি দাবি করেছেন মস্কো পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় ৩০% কম দামে পেট্রোলিয়াম পণ্য ও গম সরবরাহ করতে প্রস্তুত। খান দাবি করেছেন যে একটি বিদেশী শক্তি (মার্কিন) তার রাশিয়া সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। খান ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার সরকারকে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত। খান অভিযোগ করেন, "বিদেশী শক্তিগুলি চীনের সাথে বাণিজ্য বাড়াতে পছন্দ করেনি।"

“যেহেতু তারা এসব পছন্দ করেনি, তাই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।” খান পাকিস্তানিদের "প্রকৃত স্বাধীনতা" এর জন্য প্রচারণা শুরু করতে বলেছেন। ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বর্তমান সরকারকে তিরস্কার করে, খান অভিযোগ করেন যে তারা (মার্কিন) আইন প্রণেতাদের বিবেক কিনেছে এবং "বিদেশী শক্তির (যুক্তরাষ্ট্রর) বুট পালিশ করেছে"। কেন তার বিরুদ্ধে একটি "বিদেশী ষড়যন্ত্র" তৈরি করা হয়েছিল তার বিশদ বিবরণে গিয়ে, খান বলেছিলেন যে যেদিন তিনি ক্ষমতায় আসেন তার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি দেওয়া। খান বলেন, "একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির অর্থ হল সব সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থে নেওয়া হবে। আমি বিদেশী শক্তির (মার্কিন) জন্য আমার দেশবাসীকে বলি দিতে পারি না।" খান অভিযোগ করেছেন যে পাকিস্তানের সকল ক্ষমতাসীন শাসকরা সবসময় বাধ্য ছিলেন বিদেশী শক্তি (মার্কিন) নির্দেশ মেনে চলতে। তিনি দাবি করেন, তিনি সে নীতি অনুসরণ করেননি, তাই বিদেশী শক্তিগুলি "এটি পছন্দ করেনি"।

খান বলেছেন, তিনি প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসলামোফোবিয়ার বিষয়টি উত্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন - জাতিসংঘ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা এবং অন্যান্য - কারণ ১.৫ বিলিয়ন মুসলিম জনসংখ্যা বিদেশে সমস্যায় পড়েছে। "সুতরাং বিদেশীরাও এটা পছন্দ করেনি," তিনি বলেছিলেন।

খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেছেন যে, “পাকিস্তান যদি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক চায় তাহলে তাকে (খান) অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে অপসারণ করতে হবে।” খান অভিযোগ করেছেন যে ডোনাল্ড লু, পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া  বিষয়ক ব্যুরোর সহকারী সচিব তার সরকারকে পতনের জন্য 'বিদেশি ষড়যন্ত্রে' জড়িত ছিলেন। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি শনিবার পার্লামেন্টের বক্তৃতায় পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে শাসন পরিবর্তনের খানের অভিযোগের প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা টেলিফোন করেছেন এবং ফেব্রুয়ারিতে খানের রাশিয়া সফরে না যেতে বলেছিলেন। খানের মতে, আমেরিকানরা তার সরকারকে পতনের জন্য ষড়যন্ত্র করে কারণ তিনি ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মস্কো সফর বাতিল করতে অস্বীকার করেছিলেন। খানের শাসন আমলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির কিছু দিক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিল।  

"আমেরিকান হামে তুমহারি মাফি কি জরুরাত নাহি হ্যায় (আমেরিকা, আমাদের আপনার ক্ষমার দরকার নেই), " ইমরান তার সমর্থকদের কাছে বলছেন। খান বলেছিলেন যে তিনি সেই পাকিস্তানী নয় যেখানে আমেরিকা জোর করে জেনারেল জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ধরেছিল এবং তাকে ফাঁসি দিয়েছিল এবং চোররা (শরিফ পরিবার) তাদের সাহায্য করেছিল। খান একে 'নয়া পাকিস্তান' বলছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহে খান তার তীক্ষ্ণ পশ্চিম-বিরোধী সমালোচনার কারণে সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশ কয়েকটি দেশের বিরাগভাজন হয়েছেন। খান বলেন "আমি মনে করি আমেরিকানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভারত একটি কৌশলগত অংশীদার। সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তানের সাথে অন্যরকম আচরণ করা হচ্ছে।" পাকিস্তান অসন্তুষ্ট যে জো বাইডেন জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ইমরান খানের সঙ্গে কথা বলেননি, কিন্তু ভারতে প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। তবে, খান বলেছেন যে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফোন কলের জন্য সত্যিই "অপেক্ষা" করছেন না। প্রতিবেশী আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে খান বিডেন প্রশাসনের সমালোচনা করেছিলেন। খান আমেরিকার ড্রোন প্রোগ্রামের বিরোধিতাকারী। খান মনে করেন, আমেরিকার ড্রোন আমলার কারণে পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বে কথিত সন্ত্রাসী এলাকাগুলিকে লক্ষ্য করে হামলার কারণে পাকিস্তানের কিছু অংশে শত শত বেসামরিক মৃত্যুর হয়েছে। আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা এবং ৯/১১-এর মাস্টারমাইন্ড ওসামা বিন লাদেনকে "শহীদ" বলে অভিহিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খান সমালোচনার মুখে পড়েন।

চীনের উত্থান ঠেকাতে খান সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের নতুন শিকার। এর পেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন মনোভাব অভিন্ন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য বাইরের দেশের চক্রান্তে (মার্কিন) অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানো হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ওই নির্বাচনে বিএনপির কাছে হারের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি তো চেয়েছিলাম আমার দেশের সম্পদ আগে আমার দেশের মানুষের কাজে লাগবে। আমার ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। তারপর, আমরা ভেবে দেখব বিক্রি করব কি, করব না। …ফলাফল কী ? ……….. আমেরিকা অ্যাম্বাসির লোক, হাওয়া ভবনে বসেই থাকত। এই নির্বাচনটা.. ২০০১-এ সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে হারাবে, আর এখান থেকে গ্যাস নেবে।”

এই বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস হতে আশঙ্কা জাগে যে, বর্তমান উন্নয়ন বান্ধব রাজনৈতিক নেত্রীত্বের সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে এবং বাংলাদেশের প্রভূত অথনৈতিক উন্নয়নের পেক্ষাপটে, আঞ্চলিক চীন, পাকিস্তান, শ্রীলংকার সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টির কারণে বর্তমান সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের তৎপরতা শুরু হবে। আমেরিকা আজ মানবাধিকার রক্ষার নামে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন বিধিনিষেধ দেয়া শুরু করেছে। এটি আর কিছু নয় এই সরকারকে আজ্ঞাবহ, নতজানু করার চেষ্টা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার বক্তব্য, “আমেরিকা গণতন্ত্রের জন্য কথা বলে আর খুনিদেরকে আশ্রয় দেয়, প্রশ্রয় দেয়। কেন আমি জানি না। তারা নাকি বিশ্বের সব থেকে গণতান্ত্রিক দেশ! … তাদের কাছ থেকে আমাদের আইনের শাসনের সবকও শুনতে হয়, গণতন্ত্রের কথাও শুনতে হয়, ন্যায়বিচারের কথাও শুনতে হয়, সেটিই আমার কাছে অবাক লাগে।” ১০ ডিসেম্বর ২০২১ - আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিরুদ্ধে এবং ০৯-১০ ডিসেম্বর ২০২১ গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়। এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের উপর চীনের ক্রবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির কারণে হয়েছে।

পরিশেষে মার্কিন স্বার্থ বিরোধি হলে সরকার পতনে ভূমিকা রাখা ও গণতান্ত্রিক সরকারকে চাপে রাখা বা রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিদায় করা, আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করা সর্বপরি খানের ভাষায় "বিদেশী শক্তির (যুক্তরাষ্ট্রর) বুট পালিশ “ রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করার নীতির প্রতিবাদ হওয়া উচিত। খান জনসাধারণকে "ভাল" এবং "মন্দ" এর মধ্যে বেছে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। খান তরুণদের স্পষ্টত বলছেন তাদের পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং মার্কিন আদেশের বিরোধিতা করা দরকার । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ‘বুট পালিশ’ রাজনৈতিক দল সরকারে আনার আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার কণ্ঠস্বর ইমরান খান।

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি। কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।  

এসএ/