ইমো হ্যাকে প্রতারণার জাল
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
কৌশলে ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপির মাধ্যমে প্রবাসীদের ইমো অ্যাকাউন্টের নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রতারণার জাল পেতেছেন একটি চক্র।
পুলিশ সূত্র বলছে, অ্যাকাউন্ট থেকেই টার্গেট প্রবাসীর স্বজনদের জানানো হতো দুর্ঘটনার মতো জরুরি অবস্থার কথা। বিপদ থেকে উদ্ধারে বিকাশের মাধ্যমে স্বজনদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হতো টাকা। এমনই এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চক্রের সঙ্গে আরো কেউ জড়িত কিনা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ। প্রতারণা থেকে বাঁচতে প্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্ক থাকারও পরামর্শ পুলিশের।
রাজধানীর কাফরুল এলাকার থাকেন মনসুর রহমান। গত বছরের ২৭শে ডিসেম্বর ইতালী প্রবাসী ছেলে রেজওয়ান কবির সাকিবের ইমো অ্যাকাউন্ট থেকে ফোন করে জানানো হয় তার ছেলেকে আটক করেছে পুলিশ। ছাড়িয়ে নিতে জরুরি ভিত্তিতে দেড় লাখ টাকা প্রয়োজন জানালে তা টাকা পাঠাতে কিছু সময় চান মনসুর রহমান। এই সময়ে দেশ থেকে কয়েক দফা ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। কারণ ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে ছেলে ইমো অ্যাকাউন্টের দখল নিয়েছে প্রতারকরা। কয়েকটি বিকাশ নম্বরে কয়েক ধাপে দেড় লাখ টাকা পাঠিয়ে দিলে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এ সময় তারা জানতে পারেন রেজুয়ানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি, তারা একটি প্রতারক চক্রের ফাদে পা দিয়েছে বলে বুঝতে পেড়েছেন।
ভুক্তভোগী মনসুর রহমান বলেন,যখন শুনেছি আমার ছেলেকে জেলে ঢুকাবে তখন এত কষ্ট লাগছে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। দেড় লাখ ম্যানেজ করি এরপর তারা ৫টা বিকাশ নম্বর দেয় সেখানেই আমি ওই দেড় লাখ টাকা বিকাশ করি। গত ২৯ ডিসেম্বর রেজুয়ানের বাবা মুনসুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে গত মাসে সুইজারল্যন্ড প্রবাসী আরিফ হোসেনের ইমো নম্বর হ্যাক করে স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় একই চক্র। সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর স্বজনরা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।
এ ধরনের অভিযোগ প্রতিনিয়তই জমা পড়ছে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে একের পর এক প্রতারকদেও গ্রেপ্তার করলে থেমে নেই তাদের প্রতারণা। প্রবাসীদের টার্গেট করেই প্রতিনিয়তই তারা ইমো হ্যাক করে কৌশলে কোটি টাকা টাকা হাতিয়ে এই চক্র। প্রবাসীরা স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যাম হিসেবে ব্যবহার করে ইমো। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন প্রতারণার জাল বুনছেন তারা। মামলার তদন্তে নেমে সম্প্রতি নাটোরের লালপুর এলাকা থেকে ২১টি সিম কার্ড, নয়টি মোবাইল ফোনসহ প্রতারক মাসুদ রানাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
প্রতারণা ফাঁদ পাতে যেভাবে: প্রবাসীদের টার্গেট করেই ইমো হ্যাক করে তাদের স্বজনদের মেসেজ পাঠান। এবং মেসেজে উল্লেখ্য করা হয় সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা পুলিশ আটক। এতে লেখা থাকে আপনার ছেলে দুর্ঘটনায় গুরুত্বও আহত হয়েছে। আবার কেউ লেখেন আপনার ছেলেকে পুলিশ আটক করেছে। সঙ্গে সঙ্গে স্বজন ওই প্রতারকদের নাম্বারে টাকা পাঠান। এতে প্রতারকরা বিকাশ কিংবা রকেট অ্যাকাউন্ট নাম্বার ব্যবহার করেন।
ইমো চ্যাট গ্রপের অ্যাডমিন পরিচয় দিয়ে ওই ইমো ব্যবহারকারীর নম্বরে মেসেজ পাঠিয়ে বলা হয় অযাচিত কল ও মেসেজ থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনার ফোনে যাওয়া এসএমএস থেকে ওটিপি নম্বরটি এই নম্বরে পাঠান। যখনই কেউ ওটিপি পাঠান সঙ্গে সঙ্গে হ্যাক হয়ে যায় তার ইমো নম্বরটি।
পুলিশ বলছে, গত দুই বছর আগে মাসুদ রানা রিকশা প্যাডেল দিয়ে আয় করতে। আর তা দিয়ে চলতো সংসার। এখন মাসুদ রানা পেশা পরিবর্তন করে প্রবাসীদের টার্গেট করে ইমো হ্যাক করে রিকশা চালক থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার নাটোরের লালপুরের বাড়িতে ছিলো গোলপাতার ঝুপড়ি ঘর। এখন সেখানে আলিশান বাড়ি। এলাকায় তিনি অসহায় দুস্থদের মাঝে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। মাসুদ রানা যে সব বিকাশ নম্বর ব্যবহার করে তাও জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করা। সিম যাদের নাম উল্লেখ আছে তারা অন্য জেলার এবং তারা এ বিষয় অবগত নন। প্রতারকদের সঙ্গে নেই কোনো পরিচয়।
লালপুরের বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, মাসুদ রানা চালাতে রিকশা। রাতারাতি হয়ে গেলেন কোটিপতি। এতো দ্রুত কিভাবে এতে টাকা মালিক হলো বুঝলাম। আমরা সারাদিন এতে পরিশ্রম করে দুই বেলা ভাত খেতে কষ্ট। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার পর শুনলাম সে নাকি ইমো হ্যাক করে টাকা আয় করে।
এ ব্যাপারে ডিবির অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের প্রধান অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল হক জনবাণীকে বলেন, ইমো হ্যাক করে প্রবাসীদের টার্গেট করছে একটি চক্র। কৌশলে তারা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। প্রবাসী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইমো ব্যবহার করে থাকেন এবং এরা প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব একটা সচেতন থাকেন না। ফলে সহজেই এদের বোকা বানিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা।
তিনি আরো বলেন, আপনি যদি প্রতারকের কাছে ম্যাসেজের ওটিপি দিয়ে দেন তখনই ইমোর কন্ট্রলটা চলে যাবে সম্পূর্ণ এ্যাপেসের আন্ডারে বা ওই প্রতারকের কাছে। মাসুদ রানা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও গত এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষের ইমো অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ জনবাণীকে বলেন, ওই ব্যক্তি পাঁচটি বিকাশ নম্বরে দেড় লাখ টাকা পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয় সুইজারল্যান্ডের এক প্রবাসীরও এ ঘটনা ঘটেছে। তারা যদি আপনাদের কাছে কোন ওটিপি বা পিন নম্বর চাই দিবেন না। এগুলো দিলেই আপনি প্রতারনার স্বীকার হবেন। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আর্থিক খাতগুলোতে যুগান্তকারী সুফল বয়ে আনলেও একই সঙ্গে এর অপব্যবহার করে প্রতারণার নানা কৌশল করছে অপরাধীরা।
এসএ/