সিরাজগঞ্জের চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি যাচ্ছে দেশ-বিদেশে
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: টাকি ও চাঁদা মাছের ভর্তা, শিং-টেংরা মাছের ঝোল, সেইসঙ্গে মুলা-বেগুনের সবজিতে মিঠা পানির চ্যাং-পুঁটি মাছের শুঁটকি মানেই লোভনীয় খাবার। ভাতের সঙ্গে এ তরকারির জুড়ি মেলা ভার। বাঙালির প্রিয় খাদ্যের মধ্যে অন্যতম দেশীয় প্রজাতির শুঁটকি।
সিরাজগঞ্জের চলনবিলে এখন থইথই পানি নেই, অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে। ফলে বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে চলছে ধান কাটাসহ অন্য ফসল রোপণের কাজ। তবে বিলের নিচু জায়গায় বড় খালগুলোতে সুতি জাল, বেড় জাল, পলো দিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা। জালে ধরা মাছগুলো পাশেই অস্থায়ী বাঁশের ছাউনির চাতালে তৈরি হচ্ছে শুঁটকি। চাতালগুলোতে, চেলা, চ্যাং, পুঁটি, টেংরা, বাতাসি, চাপিলা, খলসে, মলা, টাকি, গোচই, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কৈসহ মিঠা পানির বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছের শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে।
এই অঞ্চলে উৎপাদিত এসব শুঁটকি মাছ সারাদেশের মানুষের কাছেই প্রিয়। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় মিঠা পানির এসব শুঁটকির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সে অনুযায়ী বাড়ছে শুঁটকির উৎপাদনও । দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ অঞ্চলের শুঁটকি রপ্তানি বেশি হচ্ছে ভারতে।বাণিজ্যিকভাবে ভারতে রপ্তানি হওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশেও দিন দিন কদর বাড়ছে মিঠা পানির এসব শুঁটকির।
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, তাড়াশ ও উল্লাপাড়ায় দেখা যায়, শুঁটকির চাতালে কর্মব্যস্ত রয়েছেন শ্রমিকরা। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের দু’পাশে গড়ে উঠেছে এসব চাতাল। বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ শুকিয়ে বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া চলছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের ৩টি উপজেলায় বর্ষা মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের সর্বাধিক দেশীয় মাছ উৎপাদন হয় এ অঞ্চলে। বিলের পানি কমতে শুরু করলে মাছ ধরার ধুম পড়ে যায়। আর তখনই উৎপাদন শুরু হয় শুঁটকি মাছ।
শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমান মহিষলুটি মাছের আড়তে কাঁচা পুঁটি মাছ ৮০ থেকে ৯০ টাকা, চাঁদা ৪০ থেকে ৬০ টাকা, খলিশা ৭০ থেকে ৮০ টাকা ও বেলে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ৪০ কেজি কাঁচা মাছ শুকালে ১৫ কেজি শুটকি মাছ হয়। উৎপাদিত শুঁটকি মাছ নীলফামারী, রংপুর ও সৈয়দপুরে বর্তমানে পুঁটি ১৩০-২শ টাকা, চাঁদা ৮০-৯০ টাকা, বেলে ৩শ টাকা এবং খলিশা ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এসব শুঁটকি প্রকারভেদে প্রতি মণ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা দরে পাইকারি বিক্রি হয়। মাছগুলো চাতালে নেওয়ার পর বাজারজাত করতে মাসখানেক সময় লেগে যায়।
উল্লাপাড়ার বড়পাঙ্গাসী এলাকার জেলে আয়নাল হক, জামাল শেখ, আবুল কালাম ও নিমাই জানান, শুকনো মৌসুমে তারা ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে তারা চাতাল স্থাপন করে শুঁটকির উৎপাদন শুরু করেন। অনেকে মাছ শিকারের পর আড়তে বিক্রি করেন। সেই মাছগুলো যায় শুঁটকির চাতালে। এসময় জেলেদের জালে ধরা পড়ে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির মাছ। এসব মাছ জেলেদের কাছ থেকে কিনে শুরু হয় শুঁটকি উৎপাদনের প্রক্রিয়া। স্থানীয় নারী-পুরুষেরা চাতালে কাজ করেন। এভাবে টানা ছয় মাস শুঁটকি উৎপাদন করেন শ্রমিকেরা। এ অঞ্চলে ৭০টির মতো চাতালে শতাধিক নারী শ্রমিক ও অর্ধ শতাধিক পুরুষ শ্রমিক কাজ করে।
শুঁটকির শ্রমিকেরা জানান, ৩ থেকে ৪ কেজি তাজা মাছ থেকে এক কেজি শুঁটকি উৎপাদন হয়। ভরা মৌসুমে তাজা বড় পুঁটি প্রতি কেজি ১২০ থেকে ১৫০ টাকা দরে এবং ছোট পুঁটি ৮০-৯০ টাকা দরে কেনা হয়। প্রতি মণ শুঁটকি ১৬-১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করলে কিছুটা লাভ হয়। প্রকারভেদে অন্যান্য মাছও এভাবেই কেনা-বেচা হয়।
তাড়াশ উপজেলার মান্নান নগর গ্রামের শুঁটকি উৎপাদনকারী জুলমাত শেখ বলেন, ‘শুঁটকির চাহিদা থাকলেও আড়তদারদের সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না আমরা। সকালে এক দামে কিনলেও বিকেলেই মণ প্রতি ১ থেকে ২ হাজার টাকা কমে বিক্রি করতে হয়। এতে শুঁটকি উৎপাদনকারীরা লোকসানের মুখে পড়েন।
আক্কাস আলী নামের আরেক শুঁটকি উৎপাদনকারী বলেন, আমরা শুঁটকি তৈরিতে প্রায় ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে শুঁটকি উৎপাদনের ব্যবসা করি। অনেক সময় আমাদের ব্যয় ফিরে পাওয়াই দায় হয়ে পড়ে। আমাদের হাতে তৈরি শুঁটকিগুলো ভারতেও রপ্তানি হয়। বছর ২ আগে ভারতের ব্যবসায়ীরা সরাসরি আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে শুঁটকি মাছ কিনেছে। কিন্তু বর্তমানে সৈয়দপুরের আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে ভারতীয়দের আমাদের কাছে আসতেই দেয় না।
সৈয়দপুরের ইসলামপুর এলাকার আড়তদার শাকিল বলেন, আমরা সারাদেশেই শুঁটকির সরবরাহ করি। এছাড়া ভারতেও রপ্তানি হয়। বাজারে যখন যে দাম থাকে আমরা উৎপাদনকারীদের সেই ন্যায্য দাম দিয়ে থাকি।
মহিষলুটি মাছের আড়তের ইজারদার মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘চলনবিলের মাছের শুঁটকি সুস্বাদু হয়। দিনে দিনে বিলে মাছ কমে গেলেও দেশে-বিদেশে শুঁটকির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উন্নতমানের শুঁটকি তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সাহেদ আলী বলেন, জেলার শুঁটকির সুনাম ও চাহিদা দুটোই রয়েছে দেশ ও বিদেশে। আমরা এই শুঁটকির মান বৃদ্ধির জন্য চাতাল মালিকদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা বিবেচনা করছি। প্রক্রিয়াটি শুরু হলে এই অঞ্চলের শুঁটকি ব্যবসা আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, গত বছর এ অঞ্চলে ১৬৫ টন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। এখনো প্রায় ২ মাস শুঁটকি উৎপাদনের কাজ চলবে। ফলে এ বছর শুঁটকি উৎপাদন ১৭০ টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।