কৃষকের শুভঙ্করের ফাঁকি
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। এদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ লোক কৃষক। কৃষক জাতির মেরুদন্ড। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষকের ভূমিকা অপরিসীম। এদেশে শিল্প বিপ্লবের সম্ভবনা নিকট ভবিষ্যতে নাই বললেই চলে। আর বাংলাদেশে যেহেতু শিল্প বিপ্লবের সম্ভবনা কম সেহেতু অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য কৃষি সহ অন্য সোর্সের উপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর নাই। বিশ্বের বহু দেশেই কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন করে রাতারাতি দেশের ইর্ষান্বিত উন্নতি সাধন করেছেন। সূজলা সুফলা আমাদের এই সোনার বাংলায় কৃষি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করে দেশের অর্থনীতির চাকা রাতারাতি বদলানো সম্ভব তবে তার জন্য চাই ব্যাপক পরিকল্পনা।
কোন মাষ্টার প্লান ছাড়া যেমন কোন বৃহৎ কাজ করা যায় না তেমনি কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য চাই যুগপোযুগি মহা পরিকল্পনা। আর কৃষিপণ্যের গুরুত্ব যে কি তা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, কারণ রাশিয়া বিশ্বের মোট গমের চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদন করে থাকে। সেখানে যুদ্ধ বাধার কারণে গোটা বিশ্বে গমের বাজার অস্থির। প্রখ্যাত দার্শনিক রুশোকে তাঁর শিষ্যরা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কৃষিজাত পণ্যের গুরুত্ব বেশী না শিল্পজাত পণ্যের গুরুত্ব বেশী।
দার্শনিক রুশো কিছুক্ষন চিন্তা করে বললেন কৃষিজাত পণ্যের গুরুত্ব অনেক বেশী। তার শিষ্যরা সমস্বরে প্রতিবাদ করে উঠলেন তা কি করে হয়,কারণ শিল্পজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে বহু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়, পক্ষান্তরে কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি করে আশানূরুপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভবপর নহে, তাহলে কৃষিজাত পণ্য কি করে শিল্পজাত পণ্য থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়। রুশো এক কথায় জবাব দিলেন কৃষিজাত পণ্য খেয়েই কিন্তু মানুষ শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন করে থাকে এবং এই কারণেই শিল্পজাত পণ্যের চেয়ে কৃষিজাত পণ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। আগেই বলেছি বিশ্বে মোট গমের চাহিদার সিংহভাগ উৎপাদন করে থাকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলি। বাংলাদেশের প্রতি বছর গমের চাহিদা প্রায় ৭৫ লক্ষ টন, যার ১৫ ভাগ দেশে উৎপাদন হয় বাঁকি গম ঐ সকল দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশ নহে বিশ্বের বহু দেশেই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে এবং তার জন্য গোটা বিশ্ব অস্থির অবস্থার মধ্যে আছে। যেহেতু বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ সেহেতু এই খাদ্য ঘাটতি সংকট থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য এখন থেকেই কৃষির উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, কেননা আমাদের দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য ঘাটতি থাকে, ভবিষ্যতেও যদি পৃথিবী এরকম অস্থিরতার মধ্যে থাকে তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা নাজুক অবস্থার মধ্যে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নাই। তাই কৃষি এবং কৃষককে বাঁচাতে এখনই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যেহেতু কৃষি ক্ষেত্রে কোন মহা পরিকল্পনা নাই সেহেতু কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকের অবস্থা কি দাঁড়ায় সে সম্পর্কে আমরা কোন খোঁজ খবর রাখি বলে মনে হয় না। এই বৎসর ইরি উৎপাদনে কৃষকের অবস্থা হয়েছে অত্যন্ত নাজুক।
ইরি উৎপাদনে প্রান্তিক কৃষকগুলো লাভতো দূরের কথা আসল পূজি- পাট্টা হারিয়ে বসেছে। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। ছেলের পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে, ছেলে যথারীতি রেজাল্ট নিয়ে বাড়ী ফিরছে, ছেলের হাতে রেজাল্ট সীট দেখে বাবা ছেলেকে বলছে পরীক্ষার রেজাল্ট কি ? ছেলে কোন উত্তর দেয় না। বারবার বলার পরও ছেলে যখন উত্তর দেয় নাই তখন বাবা ধমক দিয়ে বলছে, আরে পাশ না ফেল সেটাতো বলবি। ধমক খেয়ে ছেলে বলছে আবার পাশ ফেল নিয়ে টানাটানি। উত্তরে বাবা বলছে ফেলের আবার টানাটানি কি হলো, পাশ না করলে ফেলতো হবেই। ছেলে তখন বলছে এই জন্য ফেল নিয়ে টানাটানি যে নিচের ক্লাশে নামিয়ে দিতে চেয়েছিল সেটা কোন রকমে ঠেকিয়েছি। আমাদের কৃষকের অবস্থা হয়েছে তদ্রুপ, এই বৎসর ইরি ধান উৎপাদনে কৃষকরা পূঁজিতো পায়ই নাই বরং লোকসান কত কমানো যায় সেই চিন্তায় কৃষকরা ব্যস্ত ছিল।
মোঃ আরিফুর রহমান নামে একজন স্কুল শিক্ষক তিনি আবার একজন আদর্শ কৃষকও বটে, তাঁর সঙ্গে কথা বলে ইরি ধানের ফলন ও খরচ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি একবিঘা জমিতে ইরিধান উৎপাদনে যে খরচ দিলেন তার হিসাব এই রকম, প্রথমে জমি চাষ করতে লেগেছে ৮০০ টাকা, তারপর চারা লেগেছে ১০০০ টাকা, চারা লাগাতে চারজন কিষনের দাম দিতে হয়েছে ২০০০ টাকা, তিন প্রকার সার তিনবারে জমিতে দিতে খরচ হয়েছে ২০০০ টাকা, একাধিকবার কীটনাশক বাবদ খরচ হয়েছে ১৬০০ টাকা, পানি সেচ দিতে খরচ হয়েছে ২০০০ টাকা, ধান কাটতে ৮টা কিষানের খরচ গেছে ৮০০০ টাকা, এবং সবশেষ মেশিনে ধান মাড়াই খরচ গেছে ৮০০ টাকা একূনে ১৮২০০ টাকা, অন্যদিকে প্রতি বিঘায় ধান হয়েছে সর্বোচ্চ ১৬ মন, যার বাজার মূল্য ১৬০০০ টাকা, গড়ে প্রতি বিঘায় একজন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার মত। কৃষক পড়েছে শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যে।
শুধু ইরি ধান নহে রবিশস্য থেকে শুরু করে অন্যান্য ধান গম উৎপাদনের খরচের অবস্থাও একই পর্যায়ে । কৃষক এবং কৃষিকে বাঁচাতে হলে প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে রেশন কার্ডের মত সিষ্টেম করে নামমাত্র মূল্যে সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের নায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে, নচেৎ কৃষক যদি শস্য ফলাতে বিমূখ হয় তাহলে দেশের অবস্থা হবে ভয়াবহ, সুতরাং সময় থাকতে আমাদের এখনই সতর্ক প্রয়োজন।
লেখক: এড. মোঃ মোজাম্মেল হক, আইনজীবী, বগুড়া।
এসএ/