দর্শনীয় স্থান যশোরের ঐতিহাসিক এগার শিব মন্দির
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
যশোর অভয়নগর উপজেলার অভয়নগর গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক এগার শিব মন্দির। খুলনা-যশোর মহাসড়কের রাজঘাট হতে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ভৈরব নদীর উত্তর পাশে এটির অবস্থান।
একটি কিংবা দুটি নয়, একসাথে এগারোটি শিব মন্দিরের অবস্থান রয়েছে এই জায়গাটিতে। প্রায় ৩০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই শিব মন্দিরগুলোর সাথে জড়িত আছে নানা ইতিহাস। এগারো শিব মন্দির যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নে এই স্থানটি অবস্থিত। ভৈরবের পাড়ে গড়ে ওঠা এই শিব মন্দিরের সাথে জড়িত আছে এক দুঃখী রাজ কন্যার ইতিহাস। ইতিহাসের শুরু জানতে হলে ফিরে যেতে হবে বারো ভূঁইয়াদের আমলে। বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম যশোরের রাজা প্রতিপাদিত্য। মুঘলদের সাথে যুদ্ধে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত ও বন্দী হলে তখনকার রাজ পরিবারের সদস্যরা নানা দিকে ছিটকে পড়ে। যুদ্ধ পরাজিত এই রাজপরিবারের এক সদস্য ভাগ্য অন্বেষণে এসে পড়েন যশোরের চাচড়া অঞ্চলে। এদেরই উত্তরপুরুষদের একজন রাজা নীলকণ্ঠ রায় পরিশ্রম আর সৌভাগ্যে ধন দৌলত আর শক্তি সামর্থ্য গড়ে তুলেছিলেন।
নীলকণ্ঠের আমলে এই যশোর অঞ্চলে বন দস্যুদের প্রকোপ ছিলো বেশি। সুন্দরবন পার হয়ে নদী দিয়ে এসে গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে নিয়ে যেতো দুর্বৃত্তরা। এমনকি শিশু ও নারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে প্রাচার করে দিতো। এই সমস্যার সমাধানে নীলকণ্ঠ রায় ভৈরবের পাড়ে এসে দুর্গ নির্মাণ করেন ও বসবাস করতে থাকেন। তৎকালে ভৈরব নদের পাড়ে হিন্দুদের তীর্থস্থান ছিলো ভাটপাড়া। ভাটপাড়ার পাশেই রাজা দুর্গ ও রাজ প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
এখানে রাজা নীলকণ্ঠের একমাত্র কন্যা অভয়া বেড়ে উঠে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হলে তার বিয়ে ঠিক করা হয় নড়াইল জমিদার বংশের পুরুষ নীলাম্বর রায়ের সাথে। দুর্ভাগ্যের এসে হানা দেয় অভয়ার সংসারে। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অভয়ার স্বামী নীলাম্বর মৃত্যুবরণ করে এবং অভয়ার বিধবা জীবন শুরুর সাথেই জড়িত এই এগারো শিব মন্দিরের উত্থান। উনি ছিলেন মহাদেব শিবের উপাসক। অকাল বৈধব্যের আঘাতে বাকি জীবন অভয়া শিবের আরাধনা করে কাটাতে পিতার নিকট অনুরোধ করে একটি শিব মন্দির গড়ে দেয়ার। নীলকণ্ঠ মেয়ের ইচ্ছে পূরণে প্রায় ৬০ একর জায়গাজুড়ে ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করে দেন। মন্দিরের নির্মাণকাল ১৭৪৫ থেকে ১৭৬৮ সাল।
পরবর্তীতে এই অভয়ার নামেই নগরের নাম রাখা হয় অভয়নগর। চমৎকার কারুকার্য খচিত এই মন্দিরগুলো পরস্পর পরস্পরের দিকে মুখ করে নির্মিত। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য রয়েছে খিলান আকৃতি ও উপ-প্রবেশ পথ, বাঁকানো ও কোণা আকৃতির কার্নিশ। ছাদগুলো দুই স্তরে তৈরি। ভেতরের ছাদ গোলাকার। বাহির থেকে যা চালার মতো দেখতে। এখানে মন্দিরের উত্তর পশ্চিম কোনে একটা পুকুর ও রয়েছে। যদিও তা দখলদারদের অধীনে। এছাড়া পুরো জমিটার অনেকটাই দখলে রয়েছে। আর রাজবাড়িটিও নেই বেশি একটা।
১৯৭১ সালে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দ্বারা মন্দিরের মূল্যবান কষ্টিপাথরের মূর্তি, লোহার কড়ে, বর্গা, ইট, কাঠ লুণ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি মন্দিরের একটি করে শিব লিঙ্গ ছিলো। তাও চুরি হয়ে যায়। এখন মাত্র একটি শিব লিঙ্গ অবশিষ্ট রয়েছে। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত আর সংস্কারের অভাবে মন্দির গুলোর বেহাল দশা হয়ে ছিলো। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে এর সংস্কারের কাজ শুরু হয়। যা শেষ হয় ২০১৭ সালে। যা মন্দির গুলোকে নতুন রূপ দেয়। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে পূজা পার্বণ হয় ও মেলা বসে। অনেক দূর থেকে মানুষ এসে এখানে মেলায় সামিল হয়।
বিখ্যাত চাঁচড়া জমিদার পরিবারের সদস্য রাজা নীলকান্ত আনুমানিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে মন্দিরগুলো নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্যসমূহ নির্মাণে চুন-সুরকি ও পাতলা বর্গাকৃতির ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে একসাথে ১১ টি মন্দির রয়েছে এবং মন্দিরগুলো শিবের প্রতি উৎসর্গকৃত। এই কারণেই এ মন্দির এগার শিব মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ৪টি করে মোট ৮টি মন্দির রয়েছে। দক্ষিণে রয়েছে ২টি এবং উত্তর দিকে রয়েছে বড় ১টি মন্দির যা দক্ষিণমুখী। প্রত্যেকটি মন্দির মাঝখানের উঠানের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো। মন্দিরগুলো স্থানীয় প্রচলিত শিল্প রীতিতে নির্মিত। মন্দিরগুলোর দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ। কথিত আছে রাজা নীলকান্ত তার মেয়ে অভয়ার জন্য এই মন্দির নির্মাণ করেন। লোকমুখে শোনা যায় এই এগারটা মন্দিরে এগারটা শিবের মূর্তি ছিল। অতীতে নাকি কষ্টি পাথরেরও মূর্তি ছিল এই মন্দিরে।
প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থী আসেন এখানে। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জায়গাটি সংস্কার ও প্রচার করে তাহলে দেশের মানুষের পাশাপাশি আশেপাশের প্রতিবেশী দেশ থেকেও পর্যটকরা ঐতিহাসিক স্থানটি দেখতে আগ্রহী হবেন।
বর্তমানে এই এগার শিব মন্দির গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি।
এসএ/