আসামীদের ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় নিহতের অসহায় পরিবার
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
চাঁদনী ও জ্যোৎস্না দুই শিশুর খেলাধুলার ছলে একে অপরের গায়ে বালি মাটি ছুড়াকে কেন্দ্র করে বাক্কারের স্ত্রী নাসিমা আক্তার ও মাসুদ রানার স্ত্রী সেতু আক্তারের মধ্যে কথা কাটাকাটিসহ ঝগড়া হয়। আর সেই ঝগড়াকে কেন্দ্র করেই সুলতানসহ বাক্কার, ছাত্তার, আক্তার একত্রে হয়ে ২০২০ সালের ২১ শে এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে দা, লাঠি ও চাকু নিয়ে খাদিজা খাতুনের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসলে উভয় পরিবারের মধ্যে তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সুলতানের হাতে থাকা ধারালো চাকুর আঘাতে ফরহাদের মৃত্যু হয়।
পরদিন ছেলে হত্যার বিচার দাবিতে ময়মনসিংহের নান্দাইল মডেল থানায় সুলতানকে প্রধান আসামি করে মোট নয়জনের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নিহতের মা খাদিজা খাতুন। বাদী খাদিজা খাতুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মোঃ আবু তালেব ভূইয়ার বিরুদ্ধে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন এবং মোঃ আবু তালেব ভূইয়াকে পরিবর্তন করার আবেদন জানান। বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান জেলা সিআইডি।
২০২০ সালের ১২ আগস্ট মামলা তদন্ত শুরু করে ২০২১ সালের ১৮ ই জানুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র এসআই রফিকুল ইসলাম, ফরহাদ হত্যা মামলায় তিন নম্বর আসামি মোঃ আক্তার মিয়াকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিজ্ঞ আদালতে আটজনকে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তবে আদালত তাঁর অভিযোগপত্র বাদীর নারাজি আবেদনের প্রেক্ষিতে ধার্য তারিখে তা গ্রহণ না করে আরও অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে নির্দেশ দেন। ২০২১ সালের ০১ সেপ্টেম্বর পিবিআই’য়ের উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান তদন্ত শেষ করে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৮ জনকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। কিন্তু এ মামলায় ৩ নং আসামী মোঃ আক্তার মিয়াকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে তদন্তকালে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় মামলার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে আদালত তা গ্রহণ করেন এবং বাদীর নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন।
সরজমিনে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ফরহাদ হত্যা ঘটনার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এক আসামীকে গ্রেফতার করলেও বাকি আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। অপরদিকে আসামীদের মামলা-হামলার ঘটনায় প্রায় দুইবছর যাবত নিরাপত্তাহীনতায় আতংকের মধ্যে বসবাস করছে নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের তদন্তে ৮ জন আসামীর সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী মোছাঃ খাদিজা খাতুন বলেন, তুচ্ছ ঘটনায় আমার ছেলেকে ওরা নির্মমভাবে খুন করেছে। বিভিন্ন সময় ওরা মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে উল্টো আবার আমাদের নামে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। বর্তমানে আমি আমার পরিবার নিয়ে খুব আতংকে দিন কাটাচ্ছি।
নিহতের পিতা মোঃ লোকমান মিয়া বলেন, আসামীরা বিভিন্ন সময় এলাকায় বিভিন্ন অপরাধ করেছে। এ নিয়ে তাদের নামে মামলাও রয়েছে। আমাদের পরিবারের কেউ এখন বাজারে যেতে পারেনা, আসামীরা হুমকি দেয় মামলা তুলে নিতে।
প্রত্যক্ষদর্শী নিহতের ভাবী সেতু আক্তার বলেন, ছোটবাচ্চাদের বালি দিয়ে খেলাধুলাকে কেন্দ্র করেই আমার দেবরকে আসামীরা ছুরি দিয়ে গলার নিচে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে।
নিহতের বড়ভাই মোঃ হিমেল মিয়া বলেন, মামলার শুরুতেই পুলিশ আসামী করা নিয়ে আমাদের অসহযোগিতা করে। মামলার করার পরে পুলিশ আসামী ধরেনা। অথচ আসামীরা প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরাফেরা করছে।
নিহতের মামা মতি মিয়া বলেন, বাচ্চাদের খেলাধুলা নিয়ে ঝগড়ার ঘটনায় আমি মিমাংসা করে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আসামীরা সেটায় রাজী না হয়ে রাতের বেলায় আবার ঝগড়া শুরু করে।
নিহতের ছোটবোন নুরুন্নাহার বলেন, আমার ভাইকে হত্যার পর আমার চলাচল করা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। আমি স্কুলে যেতে পারি না, আসামীর ছেলেরা আমার স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক বিরক্ত করে, অকথ্যভাষায় গালাগালি করে হুমকি দেয়, গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে।
স্থানীয় সুজন মিয়া বলেন, স্থানীয় আওয়াল মেম্বার আমাকে রাতের বেলায় মোবাইলফোনে জানায় আমার ভাগ্নে ফরহাদ খুন হয়েছে। যারা এই খুন করেছে তারা এ এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।
স্থানীয় এলাকাবাসী লিয়াকত আলী বলেন, ফরহাদ খুনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল নয়জন। এরা এলাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধ করেছে। এলাকার মানুষ ওদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ।
অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার মোঃ আব্দুল আওয়ালের সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি ফরহাদ হত্যাকান্ডে জড়িত না। তবে সুলতানদের বাড়িতে জুয়া খেলা ও মাদক ব্যবসা চলতো, এটা এলাকার সবাই জানে।
জাহাঙ্গীরপুর ইউনিয়নের বর্তমান মেম্বার সোহরাব উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আসামী সুলতানের বাড়িতে জুয়া ও মাদকের জমজমাট আড্ডা ছিল। আর সেই জুয়া খেলা ও মাদক কেনাবেচায় সে সহযোগীতা ও নিরাপত্তা দিত সাবেক মেম্বার আব্দুল আওয়াল।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী সিআইডি’র উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, আমি মামলাটি তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে হত্যার ঘটনায় ৮ জনের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলেও আদালত আমার অভিযোগপত্র গ্রহণ করেনি।
অপরদিকে মামলার তদন্তকারী পিবিআই’য়ের উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মামলাটিতে সাক্ষীদের জবানবন্দিসহ তদন্ত করে প্রাথমিকভাবে হত্যার ঘটনায় ৮ জনের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছি।
নিহতের পরিবারের দাবী ফরহাদ হত্যাকান্ডে যারা জড়িত রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
এসএ/