কালের সাক্ষী নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


কালের সাক্ষী নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি

ফুলবাড়ী প্রতিনিধি: নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন স্থাপনা। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ির অবস্থান। অবিভক্ত ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার আরো আগে নাওডাঙ্গা পরগনার তৎকালীন জমিদার বাহাদুর প্রমদারঞ্জন বক্সী বাড়িটি নির্মাণ করেন। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার আগে এই জমিদার বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার প্রমদরঞ্জন বক্সী। তার শাসন আমলে এই পরগনার অধীন ছিল কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিদ্যাবাগিশ, শিমুলবাড়ী, তালুক শিমুলবাড়ী, কবির মামুদ প্রভৃতি। পাঙ্গা এলাকায় এ জমিদারের আরেকটি জোত ছিল। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে 'বাহাদুর' খেতাব পেয়েছিলেন জমিদার প্রমদরঞ্জন বক্সী । জমিদার প্রমদরঞ্জন বক্সীর তিন ছেলে এবং এক মেয়ে ছিল। তার বড় ছেলে আইন ব্যবসা এবং ছোট ছেলে প্রকৌশলী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও তার মেঝো ছেলে পড়ালেখায় ভীষণ কাঁচা ছিলেন। ফলস্বরূপ, জমিদারি সামলানোর দায়িত্ব তিনি মেঝো ছেলেকেই দেন। মেঝো ছেলে বিশ্বেশ্বর প্রসাদ বক্সী জমিদারি সামলাতে শুরু করেন।

এদিকে জমিদার প্রমদরঞ্জন বক্সীকে নিয়ে তার বাকি দুই ছেলে কুচবিহারে থাকতে শুরু করেন। শেষ জমিদার হিসেবে বিশ্বেশ্বর প্রসাদ বক্সী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তার জমিদারি টিকিয়ে রাখার। কিন্তু পরে জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে গেলে তিনিও কুচবিহারে পাড়ি জমান। তিনি চলে যাওয়াতে নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি একদম অভিভাবক শুন্য হয়ে পড়ে। এক সময় জমিদার বাড়িতে রাণীর গোসলখানা, শোবার ঘর, কয়েদিখানাসহ আরও বেশ কয়েকটি ঘর থাকলেও এখন সেসবের খুব কম অংশই অবশিষ্ট আছে। দাঁড়িয়ে থাকা সামনের প্রবেশদ্বারটি প্রায় ১০০ মিটার উঁচু।  জমিদার বাড়ির পাশে রয়েছে ত্রিশ ফুট উঁচু শিব মন্দির। শিব মন্দিরটি সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে  এটি সংস্কার করা হয়। এখনও অনেক সনাতন ধর্মের মানুষ শিব মন্দিরে আসেন পূজা অর্চনা করতে। এছাড়া, জমিদার বাড়ির ভেতরে রয়েছে একটি দুর্গা মন্দির। দুর্গা মন্দিরের সংস্কারের পর থেকে সনাতন ধর্মের মানুষজন এখানে গীতা পাঠের আসরে ভিড় করেন। একসময়ের জৌলুসময় জমিদার বাড়ি এখন বিলুপ্তির পথে। ইট-চুন-সুড়কি দিয়ে নির্মিত এই জমিদার বাড়ির পশ্চিম দিকের দোতলা ভবন ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া বেশিরভাগ দালানেরই ছাদ অবশিষ্ট নেই। পশ্চিমের একটা দোতলা দালানও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা। অবশিষ্ট আছে সামনের মূল দালান ও ভেতরের একটা ছোট কাটরা। স্থানীয়রা সেখান থেকেও বিম ও ইট খুলে নিয়ে গেছে। শত বছরের পুরোনো এ স্থাপনাকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠছে কিছু অপ্রয়োজনীয় গাছ। তাই সংস্কার আর সংরক্ষণের অভাবে ফুলবাড়ীর মানচিত্র থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি নামে এ প্রাচীন স্থাপনা ।

নাওডাঙ্গার স্থানীয়রা জানান, অবিভক্ত ভারতবর্ষে অনেক আগে নাওডাঙ্গা পরগনার জমিদার প্রমদা রঞ্জন বক্সী ৯ একর জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। তার শাসন আমলে উপজেলার বিদ্যাবাগিশ, তালুক শিমুলবাড়ী, শিমুলবাড়ী ও কবির মামুদ জোত (এলাকা) এই পরগণার অধীনে ছিল। আর বর্তমানে জেলার রাজারহাট উপজেলার পাঙ্গা এলাকায়ও এই জমিদারের আরও একটি জোত ছিল। কিন্তু জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর তার উত্তরাধিকারীরা সব কিছু ছেড়ে ভারতে চলে যান। প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।

এটির দেখাশোনাসহ পূর্ণ পরিচালনার ভার ন্যস্ত ছিল শিবপ্রসাদ বক্সীর ওপর। তার ছিল তিন ছেলে। বীরেশ্বর প্রসাদ বক্সী, বিশ্বেশ্বর প্রসাদ বক্সী ও বিপুলেশ্বর প্রসাদ বক্সী। এর মধ্যে বীরেশ্বর প্রসাদ বক্সীকে পরে জমিদারের দায়িত্বভার দেওয়া হয়। সে সময় একটি মাইনর স্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন তিনি। এখন তার পাশে গড়ে উঠেছে নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তার ইচ্ছায় সে সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুণ্য জন্মতিথি প্রতি দোলপূর্ণিমায় বাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠে দোলের মেলা বসত। সে সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে দোল সওয়ারিরা বাহারি সাজে সজ্জিত হয়ে সিংহাসন নিয়ে এই দোলযাত্রার মেলায় অংশ নিতেন। আমোদ-ফুর্তিতে মেতে উঠত দোলযাত্রার মাঠ। পর্যায়ক্রমে প্রথা অনুযায়ী সবকিছুই চলছিল যথানিয়মে। দুই ভাই কোচবিহার রাজ্যে স্থায়ী বসবাসের জন্য একটি বাড়ি ক্রয় করেন। অনেক অনয়-বিনয় করে বাবাকে সেখানে পরে নিয়ে যান। ভারতের ওই নতুন বাড়িতে শিব প্রসাদ বক্সী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর জমিদার শিব প্রসাদ বক্সী সবকিছু ছেড়ে তিনিও চলে যান ভারতে। সীমান্তঘেঁষা ফুলবাড়ী উপজেলায় ক্ষয়িষ্ণু অবয়ব নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি। জমিদার, জমিদারি শাসন, প্রজা, গোমস্তাবিহীন সেটি এখন অরক্ষিত। ইট, চুন, সুরকির নিপুণ গাঁথুনির বিল্ডিংগুলো অসাধু ব্যক্তিরা ভেঙে নিয়ে গেছে। পশ্চিম পাশের একটা দোতলা বিল্ডিং তারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।জমিদার বাড়ির সংস্কার তাই এখন সময়ের দাবি।

জমিদার বাড়ি ঘুরতে আসা সাজু আহমেদ জানান, ইতিহাস ,ঐতিহ্য ও কালের সাক্ষী হয়ে হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি । জমিদার বাড়ির ধংসাবশেষ রক্ষার্থে প্রশাসনের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

নাওডাঙ্গা স্কুল এন্ড কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক ও মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি হৃষিকেশ রায় জনবাণীকে জানান, ধ্বংসাবশেষ এই নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি সংস্কার করলে এটি একটি পর্যটক কেন্দ্র হবে, বর্তমান প্রজন্ম বুঝতে পারবে এটা একটি জমিদার বাড়ি ছিল,এই জমিদার বাড়ি যেন প্রাণবন্ত হয় সে দিকে নজর দেওয়ার জন্য অতি জরুরী।

এসএ/