নতুন শিক্ষাক্রম কতটুকু শিক্ষা বান্ধব হবে?
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষা ছাড়া কোন জাতির এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সেই শিক্ষাটি কোন ধরনের হওয়া প্রয়োজন? যে শিক্ষা গ্রহণ করে একজন শিক্ষার্থী সমাজ, রাষ্ট্র তথা নিজের জন্য কিছু করতে পারে না সেই শিক্ষা তার জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা হলো তাই, যা একজন মানুষকে তার নিজের অস্তিত্বের জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য দক্ষ করে তোলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, আমাদের বর্তমান মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই দক্ষতা সৃষ্টিতে ব্যর্থ। সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে চলছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের বিদ্যমান শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন ও পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হয়েছে ২০২২ সালে আর বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী বছর ২০২৩ সাল থেকে। ২০২৫ সালে নতুন এই শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে। নতুন শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে চলছে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ। একটি গুণগত এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হচ্ছে নতুন এই শিক্ষাক্রমে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশেষজ্ঞরা বার বার বলে আসছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়নে যে আভাস পাওয়া গেছে তা থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার। যথা: ১. পাঠ্য পুস্তকে বড় ধরনের পরিবর্তন, ২. গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, ৩. দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দান বাধ্যতামূলক, ৪. শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, ৫. মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বিভাজন বর্জন, ৬. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার বিস্তার, ৭. জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য প্রদান, ৮. নৈতিক শিক্ষাকে আরও গুরুত্ব দান, ৯. প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার এবং ১০. মানসম্মত কারিকুলাম নিশ্চিতকরণ।
নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একই বা অভিন্ন বিষয় পড়ার সিদ্ধান্তটি একদিকে প্রশংসিত হচ্ছে, অন্যদিকে সমালোচিত হচ্ছে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে একই বা অভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। এনসিটিবি জানাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তে একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত সবাইকে সমভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ থাকবে। সবাইকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন বিষয় পড়াতে গিয়ে বিজ্ঞানের আবশ্যকীয় অনেক বিষয়বস্তু ছেঁটে ফেলতে হয়েছে; যেটি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির কারণ হতে পারে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ এমনিতেই কম। প্রতিবছর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমছে। যেখানে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব সামনে রেখে, বিশেষত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে বিজ্ঞানের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন, সেখানে কেন বিজ্ঞানের প্রতি গুরুত্ব কমানো হলো, তা বোধগম্য নয়। গণিত ও বিজ্ঞানের ভিত ঠিকমতো গড়ে তুলতে পারলে তা নানাভাবে সহায়ক হয়। কিন্তু সেটি না করে এমন কিছু বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, প্রশ্নসাপেক্ষ। একটি শিক্ষাক্রমে কিছু লুক্কায়িত বিষয় থাকে, থাকে সহশিক্ষাক্রমিক বা অন্যান্য কার্যক্রম। সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা থাকলে অনেক বিষয় সরাসরি পাঠ্যপুস্তকে না রেখেও পরোক্ষভাবে এবং বিদ্যালয়ে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে শেখানো যায়। যেমনঃ মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নামে একটি বিষয় রয়েছে, যেটি শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পড়তে হবে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে বা বিষয় হিসেবে লেখাপড়া করে মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বাড়ানো যাবে, এটি সম্ভবত একটি আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে থাকবে। এর আগে প্রতিটি ধর্ম বইয়ের সঙ্গে নৈতিকতা শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। তাতে কি শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি নৈতিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে?
বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এই পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। কিছু বিষয় অবশ্য নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ধারাবাহিক বা গাঠনিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এটিকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখতে হবে। কিন্তু শিক্ষকেরা কি সঠিক ও কার্যকরভাবে শিক্ষার্থীদের সারা বছর ধরে মূল্যায়ন করতে সক্ষম? সারা বছর মূল্যায়ন করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে? এ ধরনের মূল্যায়নের জন্য শিক্ষকেরা কতটুকু প্রস্তুত? স্থানীয় নানা চাপ উপেক্ষা করে শিক্ষকেরা কি আদৌ যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করতে পারবেন? বেশ কয়েক বছর আগে বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়নের একটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সেই অভিজ্ঞতা অনুসারে উপর্যুক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। ফলে, শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হলেও কেবল যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে সেটি উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। আশা করি, এনসিটিবি এসব বিষয় সম্পর্কে সজাগ।
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা না থাকার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়। এই পরিসর পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষা না থাকার সিদ্ধান্তটি সার্বিকভাবে শিক্ষার মান উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হবে। ইতিবাচক হলে নীতিনির্ধারকেরা আগামী দিনে বার্ষিক পরীক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উঠিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে পারেন। ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষাও থাকছে না। সে হিসেবে শিক্ষার্থীরা প্রথম বড় আঙ্গিকে পরীক্ষা দেবে এসএসসিতে। সেখানে শুধু দশম শ্রেণির বিষয়বস্তুর ওপর পরীক্ষা হবে। নবম শ্রেণির পাঠ্যবিষয় বাদ রেখে শুধু দশম শ্রেণির ওপর পরীক্ষা যৌক্তিক হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের যে কয়টি বিষয় বিস্মিত করেছে, তার অন্যতম হচ্ছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটো পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত; অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ পরপর তিন বছর তিনটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর কথা প্রায়ই বলা হচ্ছে নানা মহল থেকে। সরকারও প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করার কথা বলছে। সেখানে এইচএসসিতে পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর কোনো যুক্তিসংগত উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ পড়বে, শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে পরীক্ষামুখী হবে। লেখাপড়ার আয়োজন হবে গৌণ, বাড়বে প্রাইভেট বা কোচিংয়ে পড়ার হার। সব মিলিয়ে এ সিদ্ধান্তটি মাধ্যমিক শিক্ষায় খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ও বড় ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকেরা। কিন্তু তাঁদের যথাযথভাবে তৈরি না করে শিক্ষাক্রম চালু করা হলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন অনুসারে দ্রুত যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে অনুপাত নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই অনুসারে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ্য শিক্ষক রয়েছে কি না, তা দ্রুত যাচাই করা এবং সে অনুসারে শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের মান ও শিক্ষাদানের প্রতি তাঁদের আগ্রহের বিষয়টিও প্রশ্নযুক্ত। তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণও দিতে হবে। না হলে নতুন শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে না।
শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ এ যে নির্দেশনাগুলি আছে সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতে আর কোন বাধা থাকবে না। বার বার সিলেবাস পরিবর্তন, পাঠ্য পুস্তক পরিবর্তন করলে শিক্ষার্থী সেটার সাথে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়। তাই একটি স্থায়ী ও মানসম্মত শিক্ষাক্রম, যুগপোযোগী সিলেবাস ও পাঠ্য পুস্তক এখন সময়ের দাবি। শিক্ষকদের ভাল বেতন না দিতে পারলে গুণগত শিক্ষার প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে অনেক ভালো দিক আছে। কিন্তু সেগুলির বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে বড় বিষয়। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি না করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। শিক্ষাখাতে বিদ্যমান দুর্নীতি ও অরাজকতা দূর করতে হবে। শিক্ষাবিদদেরকে শিক্ষাখাতের চালিকা শক্তি হিসাবে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা ব্যবসায়ীরা আর যাই হোক গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এক ধরনের নয়। শিক্ষায় সমতা আনতে হলে সমগ্র শিক্ষাকে জাতীয়করন করতে হবে।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, অনেক ভালো উদ্যোগ কেবল প্রস্তুতি ও যোগ্যতার অভাবে শেষ পর্যন্ত আর ভালো থাকতে পারেনি। সৃজনশীল প্রশ্নের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে সবার আগে দেওয়া যায়। নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক কিছু আশাব্যঞ্জক। দশম শ্রেণির পর একাধিক পাবলিক পরীক্ষা, কিংবা বিজ্ঞানের পরিসর কমে যাওয়ার মতো কিছু বিষয় বাদ দিলে এই শিক্ষাক্রমের ইতিবাচক দিক চোখে পড়ে বেশি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা সুখের নয় বলে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলোই মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশা করব, আমাদের শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামবে।
লেখক: মোঃ আরফাতুর রহমান (শাওন), শিক্ষক, মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা।
এসএ/