জলবায়ু পরিবর্তন ও এলজিইডির ক্রিলিক সেন্টার হবে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
আবহাওয়া মানব ইতিহাসে সভ্যতা ও বাণিজ্যের বিস্তারে ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সম্মুখীন বিশ্বে, আবহাওয়া সম্পর্কে অতীতের অনুমান এখন আর সত্য নয়। তদুপরি বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য পরিণতি হিসাবে আরও তীব্র এবং ঘন ঘন চরম আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ও স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো এবং সম্পদ বিনির্মাণে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় সেক্টরেই সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সহজলভ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রসঙ্গিক জলবায়ু তথ্যের প্রয়োজন। বর্তমানে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ জলবায়ুু তথ্য সহজলভ্য হলেও সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া, বোঝা এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। যার প্রেক্ষিতে স্থানীয় আঞ্চলিক, জাতীয় সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ দীর্ঘ মেয়াদী সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রকৌশল সংস্থা। এলজিইডি এর অভিলক্ষ্য হল কৃষি ও অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা; কর্মসংস্থান সৃষ্টি; আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন; স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ; দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং স্থানীয় পর্যাযায়ে ইতিবাচক পরিবর্তনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করা।
এলজিইডির বার্ষিক কর্ম-পরিকল্পনাজনিত বিনিয়োগ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি যা বাংলাদেশের পাবলিক বিনিয়োগের ১৫ শতাংশেরও বেশি অথচ এ সকল অবকাঠামো যেমন রাস্তা, ড্রেনেজ, সাইক্লোন সেল্টার এবং অন্যান্য স্থানীয় অবকাঠামো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি সহিষ্ণু নয়।
এলজিইডির অবকাঠামোসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি সহিষ্ণু করে তুলতে গ্রহণ করা হয় গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড, জার্মান উন্নয়ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সরকার এর আর্থিক সহায়তাপুষ্ট ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার মেইনস্ট্রিমিং প্রজেক্ট (CRIMP)| এই প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৮০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যার মধ্যে ৪০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF), জার্মান সরকার KfW এর মাধ্যমে ১৫ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার এবং ২৫ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা হিসেবে এসেছে।
CRIMP এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল স্থানীয় অবকাঠমোর পরিকল্পনা, তদারকি, রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জলবায়ু সহিষ্ণুতাকে পদ্ধতিগতভাবে সমন্বয় সাধন করা। CRIMP জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনে স্থানীয় পাইলট অবকাঠামোর মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে এবং ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট লোকাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার সেন্টার (CReLIC) স্থাপনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে এবং গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড এর নিম্নোক্ত প্রভাবক স্তরসমূহে অবদান রাখবে।
- সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ, সম্প্রদায় এবং অঞ্চলের সহনশীলতা বৃদ্ধি ও জীবিকার উন্নয়ন
- জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি থেকে অবকাঠামো এবং পরিবেশের স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি
- সিদ্ধান্ত গ্রহণে জলবায়ু তথ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি।
CRIMP দীর্ঘমেয়াদে ১০.৪ কোটি মানুষ (দেশের মোট জনসংখ্যার ৬.৮ শতাংশ) উপকৃত হবে। পাইলট অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে নির্মাণ শিল্পে ১,৭০০টিরও বেশি স্বল্পমেয়াদী, মৌসুমী, স্থানীয় ও স্বল্প-দক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হবে- যা দারিদ্র্যতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখবে। জলবায়ু সহিষ্ণু ও সারাবছর ব্যবহারযোগ্য রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যান চলাচলে বাধা ও ঝুঁকি হ্রাস, ভ্রমণের সময় হ্রাস এবং পরিবহন খরচ আনুমানিক গড়ে ২০ শতাংশের বেশি হ্রাস করে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করবে। এই প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো স্বাভাবিক সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হবে এবং এইভাবে ১৮,০০০ এরও বেশি শিশু শিক্ষা সুবিধা পাবে। অবকাঠামোর লিঙ্গ-বান্ধব নক্শা, বিশেষ করে বহুমুখী সাইক্লোন সেল্টার, জেন্ডার বা নারী-পুরুষের সমতাবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে। উল্লেখিত সকল চাকুরী অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সুবিধা সামগ্রিক দারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
CReLIC বর্তমানে CRIMP এর সহায়তায় পরিচালিত হলেও পর্যায়ক্রমে উক্ত সেন্টার এলজিইডি এর অন্তর্ভুক্ত একটি স্থায়ী অঙ্গ হিসাবে পরিচালিত হবে। এই সেন্টার অব এক্সিলেন্স (Centre of Excellence) এলজিইডির থিংঙ্ক ট্যাংক (Think Tank) এবং নলেজ হাব (Knowledge Hub) স্বরুপ কাজ করবে। জলবায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং উত্তম চর্চা (Best Practice) উদ্ভাবন, প্রশিক্ষণ, ম্যানুয়াল, গাইডলাইন, স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি তৈরির কাজ এই সেন্টারে হবে। সেন্টারটি দেশীও ও আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির সঙ্গে নেটওয়ার্ক স্থাপন করবে। এলজিইডি ছাড়াও সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান জলবায়ু সহিষ্ণু অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই সেন্টারের সুফল ভোগ করবে। এছাড়াও, CReLIC প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, এলজিইডিতে উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন স্থায়ী চাকুরীর ক্ষেত্র তৈরি হবে। প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিদ্যমান উন্নয়ন ধারার পরিবর্তন (Paradigm Shift) এর সূচনা হবে যা আমাদের সচরাচর সমূহকে পরিবর্তন করে সমগ্র দেশে জলবায়ু সহিষ্ণু এবং টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করবে।
লেখকঃ মাহমুদ রিয়াজ, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, ক্রিলিক-এলজিইডি
জি আই/