পথশিশু ও আমাদের বাংলাদেশ
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
শাহ আলম সরকার: এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্হান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে। চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ। প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি — নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
কবিতায় শিশুদের জন্য পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বহুকাল আগে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের কর্ণধার। শিশুদের মাধ্যেই সুপ্ত থাকে ভবিষ্যতের কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিভা। শিশুদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিটি অভিভাবক চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ছিন্নমূল শিশু আছে যারা তাদের অধিকার বঞ্চিত হয়ে অনাদরে ও অবহেলায় দিন কাটায়। অন্ন , বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার বঞ্চিত এ দেশের দরিদ্র ও অসহায় শিশুরা।
আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ শিশুসনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সি সকলেই শিশু। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগই শিশু।
যেসব শিশু পিতৃ কিংবা মাতৃহীন বা উভয়হীন, মা তালাকপ্রাপ্ত কিংবা বাবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত, মাদকাসক্ত কিংবা পিতামাতা সংসার চালাতে পারছে না সেইসব শিশু ঘরের বাহিরে চলে আসে রাস্তায় বসবাস শুরু করে, তাহাকে পথ শিশু বলে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকই দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করে। এরা সঠিকভাবে শিশুদেরকে গড়ে তুলতে পারে না। তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগেই থকে। তারা ছেলেমেয়েদেরকে ঠিকমত খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার প্রদানে ব্যর্থ হয়।
ছিন্নমূল এসব শিশুরাই তখন জীবন সংগ্রামে নেমে বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এসব কাজের মধ্যে রয়েছে : কুলি, হকার, রিক্সাশ্রমিক, ফুলবিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদকবাহক, বিড়িশ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি। তাছাড়া বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজে তাদেরকে নিয়োজিত করা হয়। সেই ভোর থেকে কাজ শুরু হয়ে রাতের অনেকটা সময় জুড়ে ওরা কাজ করে। একটু ভুল হলেই মালিকের হাতে মার খেতে হয় । কখনো কখনো তাকে চাকরি হারাতে হয়। সারাদিনে কাজের ধরন বুঝে ২/৩ বেলা খাবার পায় এই শিশুশ্রমিকেরা। দিনশেষে ২০ থেকে ৫০/৬০ টাকা কিংবা মাস শেষে ৫০০/৬০০ টাকা পেয়ে থাকে। যা তাদের শ্রম এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। মালিক পক্ষের কাছে কোনো দাবি তুললেই চাকরিচ্যুত হতে হয়। এভাবেই চলছে তাদের যাপিত কষ্টময় জীবন। এই বিপুল সংখ্যক পথশিশুদের একটা বিশাল সংখ্যক অংশই জড়িয়ে পড়ে নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে।
এছাড়া মিছিল মিটিং, বিভিন্ন রাজনৈতিক শোডাউনে কিংবা হরতালের পিকেটিংয়ে অহরহ পথশিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে কিংবা একবেলা পেটপুরে খাওয়ার বিনিময়ে এসব দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে এসব শিশুরা। শোডাউন ছাড়াও পিকেটিং, ভাঙচুর কিংবা ককটেল নিক্ষেপের মতো বিপজ্জনক কাজেও ব্যবহার হচ্ছে ।
বিআইডিএস ও ইউনিসেফের এক গবেষণার তথ্যমতে বাংলাদেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। কেবল ঢাকা শহরে রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৭৫৪ জনে। আর ২০২৪ সাল নাগাদ সংখ্যাটা হবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জন।
জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে সবশিশুর রয়েছে সমান অধিকার। কিন্তু এসব পথশিশুর নেই কোনো শিক্ষার অধিকার, স্বাভাবিক জীবনযাপনে মেলামেশার অধিকার নেই। ফলে এরা অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কাউকে সহজে বিশ্বাস করে না। ধ্বংসাত্মক কাজে আগ্রহ, নেতিবাচক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিচয় ও ঠিকানা অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। অনেক সময় শিশুদের পিতামাতার নাম বলতে পারে না। ফলে তাদের জন্মনিবন্ধন করা যায় না। এসব শিশু ভবিষ্যতে নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ, বিশ্বে বাংলাদেশের জন্য এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়াছে। আমাদের মাথাপিছু আয়, জিডিপির আকার, জাতীয় বাজেটের বিস্তৃতি এবং উন্নয়নসূচক জাতি হিসেবে আমাদের আত্মমর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আমাদের এ অর্জন ব্যাহত হবে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে আমাদের। পথশিশুদের অনিশ্চিত ও অন্ধকার জীবনের কথা আমরা সবাই জানি। আমাদের মনুষ্যত্ববোধই পারে তাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে। এখন দরকার যার যার অবস্থান থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা। তাহলেই পরিস্থিতির সমাধান সম্ভব।
-২-
বাংলাদেশে পথশিশুদের নিয়ে ১৭টি এনজিও নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের নিজ অর্থায়নে এবং উদ্যোগে পথশিশুদের কল্যাণে কাজ করছে। এসব সংগঠন নিত্য ঘাত-প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা পথশিশুদের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগ্রত করে তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটি মহৎকর্ম। এনজিও ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের চলমান কার্যক্রম যাতে আরও ফলপ্রসূ হয় অর্থাৎ আরও অধিকসংখ্যক পথশিশুকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনা যায়, সেজন্য তাদের সামগ্রিক কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন।
সরকার ‘পথশিশুদের উন্নয়ন কার্যক্রম’ নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেখানে শিশুদের থাকা খাওয়া এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। পথশিশুদের জন্য সরকার শেল্টার হোম করছে। কিন্তু পথশিশুরা সেখানে যেতে চায় না। পথশিশুরা স্বাধীনভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত। তারা তাদের ভালো-মন্দ নিজের মতো করে বোঝে। এসব শেল্টার হোমের নিয়মকানুন তারা বুঝতে চায় না। তাদের কাছে এগুলো বন্দিশালার মতো মনে হয়। এসব শেল্টার হোমকে পথশিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে তাদের মানসিক পরিবর্তন করতে হবে। তাদের চাহিদা পূরণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এ শেল্টার হোমগুলো শিশুবান্ধব করতে হবে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনি ইশতাহার ২০১৮ এর লক্ষ্য ও পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে পথশিশুদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের জন্য শিশুসদন প্রতিষ্ঠা এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা উন্নত ও প্রসারিত করা হবে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ‘একটি শিশুও রাস্তায় থাকবে না, রাস্তায় ঘুমাবে না’। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই সচেতন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বর্তমানে উন্নীত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার পথে ধাবমান আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উন্নত বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করবে, থাকবে না সেখানে সুবিধাবঞ্চিত কোনো গোষ্ঠী। এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
লেখক- ক্রয় কর্মকর্তা, তথ্য অধিদফতর, পিআইডি ফিচার