মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষায় হোক বিজয়ের দিনের প্রতিজ্ঞা
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
প্রভাত সূর্যের রক্তাভা ছড়িয়ে বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশসহ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন আজ। এ মহান বিজয়ের সাথে মিশে আছে লাখো শহিদের রক্ত ও আত্মত্যাগ। এ আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের চলার পাথেয়, আমাদের চেতনা। উপনিবেশবাদ থেকে মুক্ত করে তোমাদের রক্তের বিনিময়ে তোমরা আমাদের দিয়েছ স্বাধীনতা, কিন্তু আমরা এখনো নব্য উপনিবেশবাদের অন্তর্জালে বন্দি! তোমরা আমাদের মুক্ত করেছ পাকিস্তানি নামক নরপিশাচদের নিষ্ঠুর যাতাকল থেকে, কিন্তু আমরা এখনো মুক্ত হইনি সাম্রাজ্যবাদের কড়াল থাবা থেকে। তোমরা চুপিসারে দেখে যাও বাংলা মায়ের আজ করুণ আর্তনাদ৷ এ ব্যর্থতা আমাদের, এ ব্যর্থতা আমাদের রাজনীতিকদের! তোমরা যে পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলে, যুদ্ধ করেছিলে সেই জান্তাও নতুন খোলসে, নতুন পোশাকে, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে পালাক্রমে ধর্ষণ করে যাচ্ছে তোমাদের চেতনাকে, তোমাদের স্বপ্নকে।… তারা আগুনে ঝলসে দিচ্ছে, বোমায় ক্ষত-বিক্ষত করছে আমাদের প্রিয় বাংলা মায়ের শরীর!
তোমাদের রক্তের শপথ, তোমাদের আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না৷ কবির কণ্ঠের সাথে গাহিতে চাই –আসিতেছে শুভদিন, দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ৷”
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সারা দেশে উড়েছিল বিজয়ের পতাকা। এসেছে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণ৷ নয় মাসের যুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে অনেক হারাতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। লাখো শহিদের রক্ত কি বৃথা গেছে? নাকি যে আকাঙ্খা নিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল লাখো মানুষ, তাদের সব আকাঙ্খা পূরণ হয়েছে? এক কথায় কোনো প্রশ্নের উত্তরই দেয়া সম্ভব নয়।
বিজয়ের চার বছর পূর্তির আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য এবং চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে যে ঘনঘোর লেগেছিল, সেই ঘনঘোর বিজয়ের পঞ্চাশ বছরেও কাটেনি।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ এখানে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা অর্জনের দৃঢ় প্রত্যয়৷৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় দলিলও স্বাক্ষরিত হয়েছিল এখানেই। স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশে আছে বাঙালি জাতিসত্তার অমরতার প্রতীক ‘শিখা চিরন্তনী’। স্বাধীনতা স্তম্ভটি বস্তুত ১৫০ ফুট উঁচু একটি গ্লাস টাওয়ার। বরং যে দেশের মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে শুরু করা স্বাধিকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতায় রূপ দিয়েছিল, সে দেশের মানুষের মাঝে বপন করা হয়েছে ‘বাঙালি না বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’-এর দ্বন্দ্ব।
বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতসহ আরো কিছু দেশের মতো বাংলাদেশও স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর সাংবিধানিকভাবেও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়েছে। তবে ক্ষমতার পালাবদলে শাসকের ইচ্ছাপূরণের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশে রাষ্ট্রধর্মও যোগ হয়েছে সংবিধানে।
খুঁজলে আরো বিতর্ক, আরো বৈপরিত্যের উল্লেখ করা যাবে, যেগুলো ‘৭১-এর শহিদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী সাধারণ মানুষদের স্বপ্নে ছিল না। সেখানে উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা নিশ্চয়ই আসবে৷ অবাধ ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল তা সম্ভব হতে পারে। এছাড়া ‘৫২-র ভাষা আন্দোলন এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যোগফলে ভাষা এবং সংস্কৃতিকে সব জায়গায় অগ্রাধিকার দেয়ায় সাফল্য-ব্যর্থতার প্রসঙ্গটিও খুব বড় হয়ে উঠবে অবশ্যই।
এসব অপ্রাপ্তিকে সাথে নিয়েই করোনা পরবর্তী কঠিন সময়ে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভলগ্নে বাংলাদেশ৷ এ দেশে বিশ্বব্যাংক তাকিয়ে দেখে পদ্মা সেতু। দুর্নীতির ধারাবাহিকতা বা আরো বাড়বাড়ন্তের মাঝেও একটি বিষয়ে অন্তত খুব গর্ব করতে পারে বাংলাদেশ- অর্থনীতির অনেক সূচকে ‘৭১-এর শত্রুপক্ষ পাকিস্তানের চেয়ে তো বটেই, এমনকি ‘মিত্র’ ভারতের চেয়েও অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ।
বিজয়ের দিনে সংকল্প হোক – দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ক্ষমতাসীনদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের যে প্রবণতা, তা দূর করা এবং বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান আবার পুনঃপ্রবর্তন করা।
প্রশ্নও থাকে একটা— রাষ্ট্রের আদর্শের ভিত্তিটা যদি ভেঙে যায়, তাহলে সে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কীভাবে রক্ষা করা যাবে?
আমরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করব এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে যাতে দেশটি গড়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখব। এটিই হোক আজকের এই বিজয় দিবসের শপথ!