অর্থনীতি উন্নয়নে পদ্মা সেতু সম্ভাবনার মাইল ফলক


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


অর্থনীতি উন্নয়নে পদ্মা সেতু সম্ভাবনার মাইল ফলক

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করে বাংলাদেশের অর্থনীতির বাঁক বদলের সূচনা হয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। এই পদ্মা সেতুই হবে অর্থনীতির সম্ভাবনার নতুন মাইল ফলক। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি দারিদ্র্যপীড়িত জেলার উন্নয়নে হবে গতি সঞ্চার। পর্যটন, কৃষি, শিল্প-প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে অর্থনীতিতে অনন্য মাত্রা যোগ করবে।পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথপরিক্রমায় এবং জাতীয় আত্মমর্যাদার একটি ব্যতিক্রমী মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাধা দূর হবে এবং একটি সমন্বিত ও একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ উন্মোচিত হবে, যা বাংলাদেশের শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নেরও অন্যতম পূর্বশর্ত।

একটি দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নে অঞ্চলগুলোর জন্য একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অনস্বীকার্য। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা বদলে দেওয়া এই সেতু (মূল সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, দুই প্রান্তের উড়ালপথ ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার) পদ্মা নদীর মাওয়া পয়েন্টে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ফরিদপুর জেলাগুলোর উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

দেশের দক্ষিণে বসবাসরত জনজীবনের জীবনমান উন্নয়নসহ স্বল্প সময়ে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত ও বাজার সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কাঁচামাল দ্রুততার সঙ্গে সরবরাহের সুযোগ তৈরি ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে এ সেতু। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে এবং এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে।

সেতুটির কারণে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা চট্টগ্রাম বন্দরের মতো যথাযথভাবে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আরেকটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পদ্মা সেতু ও সংযোগ সড়ক এশিয়ান হাইওয়ে রুট এএইচ-১-এর অংশ হওয়ায় তা যথাযথ ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহণে সুবিধা হবে।

চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু। এ সেতু দেশের ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। পদ্মা সেতু থেকে যে টোল আদায় হবে তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে বিনিয়োগ। এই সেতুর ফলে জিডিপিতে অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া দেশের সার্বিক জিডিপির পাশাপাশি পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটির সম্পূর্ণ  কাজ সমাপ্ত হলে অতিরিক্ত ১.২৩ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সেতুটি যোগাযোগের জন্য উন্মুক্ত হলেই দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলা সরাসরি সারা দেশের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি লাঘব হবে। ঢাকা থেকে খুলনা, মোংলা, বরিশাল, কুয়াকাটা অর্থনৈতিক করিডর খুলে যাবে। এ সেতুকে ঘিরে বিশদ অঞ্চলজুড়ে গড়ে উঠবে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে এবং দেশের শিল্পায়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। সেতু ঘিরে পদ্মার দুপারে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। শুধু তাই নয়, কোটিরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতির জন্য বয়ে আনবে সুসংবাদ ও সম্ভাবনাময় সোনালি ভবিষ্যৎ।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা ও সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট বিভিন্ন দ্বীপে মালদ্বীপের মতো পর্যটন খাতে গতি সঞ্চারিত হবে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবন ও পায়রা বন্দরকে ঘিরে দেখা দেবে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা। চালু হবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন চর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনের বিশাল জগৎ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সেই সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার ফলে কক্সবাজারের চেয়ে কম সময়ে সুন্দরবন ও কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। কক্সবাজার যেতে যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা, সেখানে কুয়াকাটায় পৌঁছানো যাবে মাত্র পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টায়, ফলে নিঃসন্দেহে পর্যটকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাড়বে। পায়রা বন্দরের সঙ্গে বুলেট ট্রেন চালুর কথা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কুয়াকাটা ও আশপাশে বেশ কিছু দ্বীপের সঙ্গে ভালো ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। তাহলে পর্যটকরা নানাভাবে আকৃষ্ট হবে। এজন্য এরই মধ্যে অনেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর ও এর আশপাশে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে পদ্মার দুই পারে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এরই মধ্যে বেশকিছু আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। এই সেতু ঘিরে কী কী নির্মিত হতে পারে, কোথায় শিল্পকারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে সেসব ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে।

পদ্মা সেতুর সুফলের আওতা বাড়াতে এর ওপর দিয়ে স্থাপনা করা হয়েছে রেললাইন। এর অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকা থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ উন্মুক্ত হবে। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পদ্মা সেতু হয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নড়াইলসহ নতুন পাঁচ জেলা রেলওয়ের সেবার আওতায় আনা হচ্ছে। এর আগে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, এ অঞ্চলগুলোয় অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে প্রস্তাবিত রেলওয়ে নিয়ামক ভূমিকা পালন করবে।

পদ্মা সেতু নিতান্তই একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু নয়। বিশ্বের সেরা প্রকৌশলবিদ্যা আর প্রযুক্তিতে নির্মিত দ্বিস্তরের এ দৃষ্টিনন্দন সেতুটি একটি দেশের জনগণের হৃদয়মথিত আবেগের নাম। স্বপ্ন পূরণে একটি বিশ্বাস ও আস্থার সার্থক রূপায়ণের নাম। এটি সহজেই অনুমেয়। গোটা জাতি এখন ইতিহাসের সাক্ষী, এক অনন্য গৌরবের অংশীদার হতে পেরে। তাই তো কবির ভাষায় বলতে হয়-  সাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়।। পদ্মা সেতু এখন পৃথিবীর কাছে রোল মডেল। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। সোনালি স্বপ্ন এখন কল্পনা নয়, সত্যিই দৃশ্যমান। নিশ্চয়ই এ সেতু অর্থনীতির সেতুবন্ধন ও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে।

লেখক: মোঃ আরফাতুর রহমান (শাওন), শিক্ষক ও কলামিস্ট, মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা।

এসএ/