শিক্ষক হত্যা ও অবমাননা: নৈতিকতা কি তাহলে এখন হুমকির মুখে?
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হোক তা সচেতন সবাই চাই। আবার শিক্ষকদের নিবেদিত প্রাণ হওয়া শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে একজন শিক্ষককে সে ধরনের ভূমিকায় সমাজ দেখতে চায়। কিন্তু ইদানীং সব ঘটনাকে ছাপিয়ে একটি বিষয় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখছি। দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকগণ অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতেও নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
সম্প্রতি গত দুইটি ঘটনা শিক্ষক মহলসহ শিক্ষক সমাজের প্রতিটি হৃদয়কে ভাবিয়ে তুলেছে। জাতি লজ্জায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২৬ জুন সাভারের ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্র প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শনিবার দুপুরে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারধরের শিকার হন তিনি। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়। জানা যায়, প্রভাষক উৎপল কুমার সরকার শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখতেন। দশম শ্রেণির ওই ছাত্র ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় তাকে বোঝালেও সে সংশোধন হয়নি। উল্টো ক্ষিপ্ত হয়ে প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পেটায় এবং আঘাতে মৃত্যু হয়। তাছাড়া ১৮ জুন ফেইসবুকে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরান মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু ব্যক্তি৷ স্বপন কুমার বিশ্বাস ওই কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
এটা কেমন কথা? একজন শিক্ষক তা সে যেকোনো পর্যায়েরই হোক, যেকোনো বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেসব নিয়ে চুপ কেন? শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করাই ছিল যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?
শিক্ষক নিজেই যদি শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন; তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কথাটি বারবার উঠে আসছে। বিদ্যালয় তো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের শিক্ষকসমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তটস্থ থাকেন শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়, যা তাদের কর্মস্পৃহাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে শিক্ষায় মণ্ডিত করা হবে। তাছাড়া শ্রেণি কক্ষে পাঠদানে ব্যাঘাত, শিক্ষকের প্রতি অসম্মান, শিক্ষকের আদেশ অমান্য করাসহ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেওয়ার অপরাধে সারা দেশেই হেনস্তা করা হচ্ছে বহু শিক্ষককে। তাছাড়া শাসন করতে গেলে চোখ রাঙ্গানোসহ অভিভাবকরা নালিশ এবং ক্ষমতার হুমকি দেন। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতিমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে। কে টিকিয়ে রাখবে; যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হচ্ছে আগামীর প্রজন্মের কাছে?
আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়, আমি অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোনো পর্যায়ের কোনো শিক্ষকের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই পচন দূর করতে হলে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক।
লেখক: মোঃ আরফাতুর রহমান (শাওন), শিক্ষক ও কলামিস্ট, মিল্লাত উচ্চ বিদ্যালয়, বংশাল, ঢাকা।
এসএ/