‘মারছি তাতে কী হইছে’
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
দিল্লির বাদশা আলমগীরের ছেলে শিক্ষক মাওলানার পায়ে অজুর পানি ঢালার দৃশ্য দেখে বাদশা মাওলানার উপর রেগে গেলেন। রাগের কারণ বাদশাহের ছেলে শুধু হুজুরের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন। হাত দিয়ে হুজুরের পায়ের ময়লা পরিস্কার করে দিচ্ছিলনা। বাদশাহ আলমগীরের কাছে শিক্ষকের মর্যাদা এত উঁচু ছিলো। জ্ঞান জিনিসটি সম্পুর্ন ছাত্র-শিক্ষক আত্মার লেনদেন।
একজন শিক্ষক তাঁর জ্ঞানের শেষ রস টুকু প্রিয় ছাত্রদের জন্য উজাড় করে দেন। ছাত্ররা অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করে সমৃদ্ধ হয়। তাই শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্ক হতে হবে শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের। একসময় যে রাস্তায় শিক্ষক হেঁটে যেতেন সে রাস্তায় ছাত্র থাকলে লুকিয়ে পড়ত। অথবা সালাম দিয়ে কোন রকমের পালিয়ে বাঁচত। যুগের পরিবর্তনে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে তা অবশ্যই ভালো দিক।
তবে পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে এখন পুরো উল্টো চিত্র। এখন আর শিক্ষক দেখলে ছাত্র পালায়না বরং ছাত্রের হাতে অপমান থেকে বাঁচতে শিক্ষক পালিয়ে বাঁচেন, আত্মহত্যা করেন। স্ট্যাম্পের আঘাতে মারা পড়েন। নয়তো শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরান। সাংসদ প্রকাশ্যে হকিস্টিক দিয়ে পিটান। আধুনিকতা, অনলাইন আসক্তি, পারবারিক ও নৈতিক সংকটের কারণে আমাদের সন্তানেরা দিন দিন ধ্বংসের তলানীতে পৌঁছে গেছে।
একজন শিক্ষার্থীর লক্ষ্য কেবল জ্ঞান অর্জন নয়। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সুনাম বৃদ্ধি করা। সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে দেশের কল্যাণ বয়ে আনা। কিন্তু সহপাঠীর সাথে প্রেম ও রাজনীতি সহ সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের চরম অধঃপতন হয়েছে। দেশের নামকরা স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পোষাক, চুলের কাট দেখলে বুঝা যায় আধুনিকতার নামে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিজের ক্লাসমেট ও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ইভটিজিং করেন। এসব অপকর্মের জন্য শাসন করায় (২৫ জুন) বখাটে ছাত্র আশরাফুল আহসান জিতুর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে। ঘাতক জিতু সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্র। উগ্র মেজাজি জিতু (১৯) এলাকায় বেয়াদব ও বখাটে হিসেবেই পরিচিত। স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় সে কাউকেই পাত্তা না দিয়ে বেপরোয়া চলাচল করত। এলাকায় আবার ‘জিতু দাদা’ হিসেবেও পরিচিত। বিদ্যালয়ের মেয়েদের ইভিটিজিং করা ছিলো তার নেশা। এই জিতু একদিনে তৈরি হয়নি। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতা জিতুদের খুনী হিসেবে তৈরি করছে।
৭ জুলাই রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সরকার দলীয় সংসদ-সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী রাতে চেম্বারে ডেকে গোদাগাড়ীর রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করেন। এমপি ফারুক চৌধুরীর বেপরোয়া লাথি, কিল-ঘুসি ও হকি স্টিকের আঘাতে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ও আতঙ্কিত ওই শিক্ষক এখনো ভীতসন্ত্রস্ত্র। ঘটনার পর লজ্জা ও আতঙ্কে কোথাও কোন অভিযোগও করেননি। এমপি ফারুক যে এই প্রথম কাউকে পিটিয়েছেন তা নয়। এর আগেও অনেক ব্যক্তিকে তিনি পিটিয়েছেন। তবে একজন সংসদ সদস্যের বিচার কে করবে?
সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে এভাবে জিতুরা একদিন এমপি ফারুক হয়ে উঠে। শাসন করার অপরাধে নিজ শিক্ষক পিটিয়ে মেরে বখাটে জিতু দাম্ভিকতার সাথে বলে, “মারছি তাতে কী হইছে”। যদি সঠিক বিচার হত তাহলে জিতু কিংবা এমপি ফারুক শিক্ষক পেটানোর সাহস করতনা। কিন্তু আমাদের বিচার ব্যবস্থা, সমাজ ও আশপাশের ত্রাসের পরিবেশ জিতু ও এমপি ফারুকদের বেপরোয়া করে তুলেছে।
আমরা স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর দিকে তাকালে দেখি বখাটে ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের মানিয়ে চলেন শিক্ষকেরা। তাদের সাথে অমিল হলে টিকে থাকা যায়না। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। শিক্ষকের প্রতি অশ্রদ্ধা, নির্যাতন ও খুন করে কোন জাতি সভ্য হয়ে উঠতে পারেনা।
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড হলে শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক। মেরুদণ্ডের মেরুদণ্ড ভেঙে সোজা হয়ে দাড়াতে চাইলে তা কখনো সম্ভব নয়। সুতরাং শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ ও শিক্ষদের জন্য বিশেষ সুবিধা চালু করা। যে কোন শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনা বিশেষ ট্রাইবুনালে দ্রুত বিচার করা জরুরি। না হলে মেধাবীরা যেমনি শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইবেনা। তেমনি শিক্ষাখাতের বিশৃঙ্খলা বেড়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের গাম্ভীরতা হারাবে।
লেখক :চৌধুরী মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, গণমাধ্যম কর্মী।
এসএ/