একযুগেও নেই মুসলিম শিক্ষক, নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত!


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১২:২৭ অপরাহ্ন, ৩০শে জানুয়ারী ২০২৫


একযুগেও নেই মুসলিম শিক্ষক, নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত!
ফাইল ছবি।

সারওয়ার মাহমুদ, চবি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সংস্কৃত বিভাগে একযুগেও কোনো মুসলিম শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা এটিকে দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত বৈষম্যের ফলাফল বলে দাবি করছেন।


১৯৭৪ সালে অধ্যাপক ড. আব্দুল গফুরের হাত ধরে প্রাচ্যভাষা নামে চালু হওয়া বিভাগটি ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি ভেঙে ‘সংস্কৃত’ ও ‘পালি’ নামে দুটি পৃথক বিভাগে বিভক্ত হয়। বর্তমানে সংস্কৃত বিভাগে দশ জন শিক্ষক কর্মরত থাকলেও তাদের সবাই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষক নিয়োগসহ পরীক্ষার ফলাফলে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। দশ জন শিক্ষকের মধ্যে আবার ২ জন অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত(পবিত্র কুমার হীরা ও হিমেল কর্মকার)জানা গেছে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য জোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভাগের নয়জনই নিয়োগ পেয়েছেন বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।


আরও পড়ুন: ডুয়েটে দিনব্যাপী ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপো এন্ড জব ফেয়ার-২০২৫ অনুষ্ঠিত


সংস্কৃত বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুসলিম শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে কম নম্বর দেওয়া হয়, যাতে তারা ভালো সিজিপিএ অর্জন করতে না পারে। এমনকি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও মুসলিম প্রার্থীদের বরাবরই উপেক্ষা করা হয়।


এসব অভিযোগ গুলোর মাধ্যমে যে নামটি বারবার সামনে আসে তিনি হলেন বিভাগের বর্তমান সভাপতি ও সাবেক সহকারী প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক ড.লিটন মিত্র।


বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায় ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগের জন্য উক্ত বিভাগ থেকে মাত্র একজন মুসলিম ছাত্র আবেদন করলে ভাইভার চিঠি যেন না পায় এজন্য লিটন মিত্র, শান্তি রানী হালদারসহ বিভাগের এই সাম্প্রদায়িক চক্রটি বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন উপাচার্যের সহায়তায় রেজিস্ট্রার অফিস থেকে ভাইভার চিঠি পেয়ে তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ভাইভাতে না যাওয়ার জন্য তার উপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়। সবকিছু উপেক্ষা করে ভাইভা দিতে  গেলে সেখানে রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ ও হেনস্তা করেন নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব শান্তি রানী হালদার। বিভাগে তিনি ছাড়া আর কোনো মুসলিম শিক্ষার্থী শিক্ষক নিয়োগের শর্ত অর্থাৎ সিজিপিএ ৩.৫০ এর উপরে তুলতে পারেননি।


 ভোক্তভোগী সাবেক শিক্ষার্থী জানান, নিয়োগ পরীক্ষার জন্য আবেদন করলে নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হন। তার মৌখিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র গায়েব করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরীক্ষা দিলেও তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, সংস্কৃত বিভাগের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক লিটন মিত্র ও তার সহযোগীরা এই ষড়যন্ত্রের মূল পরিকল্পনাকারী।


একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তাদের পরীক্ষার নম্বর ইচ্ছাকৃতভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ভালো ফলাফল করতে না পারে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, "আমার মাস্টার্সের সিজিপিএ এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে আমি ইমপ্রুভমেন্ট পরীক্ষাও দিতে না পারি। বিভাগে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করা প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে।"


অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সংস্কৃত বিভাগের সভাপতি লিটন মিত্রের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে, যারা মুসলিম শিক্ষার্থীদের দমন করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করছে। অভিযোগ রয়েছে, লিটন মিত্র তার ঘনিষ্ঠ সহচর, সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর এপিএস ও চবি ছাত্রলীগের সাবেক নেতা অমিত কুমার বসুর রাজনৈতিক প্রভাব ও সহযোগিতায় বিভাগে সাম্প্রদায়িক নিয়োগনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন।চবি ছাত্রলীগের সাবেক নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন ইসকন সমর্থিত শিক্ষক লিটন মিত্র।


একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, মুসলিম শিক্ষার্থীদের ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে হয়রানি করা হয়, যাতে তারা নিয়োগ ও ভালো ফলাফলের সুযোগ না পায়।


২০১৩-১৪ সেশনে লিটন মিত্রের ভাগিনা সন্দীপ বিশ্বাস ‘তবলা কোটায়’ জালিয়াতির মাধ্যমে সংস্কৃত বিভাগে ভর্তি হন, যা নজিরবিহীন ঘটনা। কারণ ‘তবলা কোটা’ শুধুমাত্র সংগীত বিভাগের জন্য প্রযোজ্য। বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করায় ইসমাইল শেখ নামে এক শিক্ষার্থীকে হুমকি দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।


বিভাগের কয়েকজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীও স্বীকার করেছেন যে, মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। প্রদীপ হালদার নামে এক চাকরি প্রত্যাশী জানান, "আমি তিনবার শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা দিয়েছি, কিন্তু লিটন মিত্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক না থাকায় আমাকে শিবির-ছাত্রদল ট্যাগ দিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে। ভাইভা বোর্ড থেকে বলা হয়েছে যতদিন লিটন মিত্র ও শান্তি রানী হালদার এই বিভাগে থাকবে তুমি নিয়োগ পাবে না।"


অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্কৃত বিভাগের সভাপতি লিটন মিত্র সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন,


"শিক্ষক নিয়োগ ও ফলাফলে বৈষম্যে আমার কোনো ভূমিকা নেই।আমি কোনো দিন নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলাম না আমি কারো নিয়োগে হস্তক্ষেপ করবো।ভাইভার চিঠি যায় শিক্ষক নিয়োগ সেল থেকে। শিক্ষক নিয়োগ সেল ও নিয়োগের জন্য আলাদা বোর্ড রয়েছে।


ফলাফলে বৈষম্যের বিষয়ে তিনি বলেন, পরীক্ষার খাতা সনাক্ত করার সুযোগ নেই পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা গুলো ৩জন পরীক্ষক দ্বারা মূল্যায়ন করা হয় তাই আমার একার পক্ষে এটা করা অসম্ভব এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তি নেই।২০১২ সালে আমি নিয়োগপ্রার্থী ছিলাম।রেজাল্ট ভালো ছিল বিভাগে এজন্য ভাইভা দিয়েছি এবং নিয়োগ পেয়েছি এর বাইরে আর কিছু নয়।


অভিযুক্ত শিক্ষক আরো বলেন,সন্দীপের(লিটনের ভাগিনা)ভর্তির ব্যাপারেও আমার কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না অভিযোগকারীদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকলে তা পেশ করার কথা বলেন তিনি।


বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরীক্ষা খাতা মূল্যায়নের সময় শিক্ষকদের ইচ্ছাকৃতভাবে নম্বর কমিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রথম দুই পরীক্ষক যদি পরিকল্পিতভাবে নম্বর দেন এবং ব্যবধান ১০-এর কম হয়, তবে তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে খাতা মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয় না। ফলে এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের নম্বর কমিয়ে দেওয়া সহজ হয়।


আরও পড়ুন: ডুয়েটে ‘মাদক রোধ ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ’ শীর্ষক সিরাত সেমিনার অনুষ্ঠিত


এদিকে অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন,


"সংস্কৃত বিভাগে মুসলিম শিক্ষকের অনুপস্থিতির বিষয়টি আমিও শুনেছি, তবে এখনো বৈষম্য হয়েছে এমন কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই তদন্ত করা হবে।"


বিভাগে অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বিষয়ে তিনি বলেন, সার্কুলার ব্যতীত কারো চাকরি স্থায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।


তবে এই বিষয়ে চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতার এবং উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দিন খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।


আরএক্স/