পদ্মা চরের বাদাম চাষিদের স্বপ্নভঙ্গ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৬ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


পদ্মা চরের বাদাম চাষিদের স্বপ্নভঙ্গ

মানিকগঞ্জে পদ্মা নদীর চর এলাকাগুলোতে বাদাম চাষ করে দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষগুলো। কিন্তু এ বছর ভাঙন ও আগাম বন্যায় তাদের সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়েছে।

একদিকে নদী ভাঙন অপরদিকে পরিপক্ব হওয়ার আগেই ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় বাদামের ফলন ভালো হয়নি। প্লাবিত চরে আশানুরুপ ফলন না হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাদাম চাষিরা।

জানা গেছে, জেলার হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলার বিভিন্ন চরে ব্যাপক বাদাম চাষ হয়ে থাকে। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় চরের দরিদ্র পরিবারগুলো কয়েক বছর ধরে বাদাম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে।

ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে বোরো ধানের বদলে বাদাম চাষ করেন এসব এলাকার চাষিরা। এগুলো জুন-জুলাই মাসে উত্তোলন করা হয়। বাদাম চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে চরের বেলে মাটিতে তেমন একটা ফসল হতো না। ফলে এখানকার মানুষের অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী।

গত কয়েক বছর ধরে পলি জমে ভরাট হওয়া চরের জমিতে ব্যাপকভাবে বাদাম চাষ হচ্ছে। এতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন চাষিরা। কিন্তু এ বছর ভাঙন জোরদার ও পানির নিচে ক্ষেত ডুবে থাকায় বাদামের ফলন ভালো হয়নি। প্রতি একর জমিতে ২৪ থেকে ২৫ মণ ফলন হলেও এবার ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা।

শিবালয় উপজেলার সুকুলিয়ার চরের হানিফের ২০ বিঘা, আমিরুলের ১৫ বিঘা, রঘুনাথপুরের আব্দুর রশিদের ৩০ বিঘা, ও আলোকদিয়া চরের মুজাম্মেলের ১০ বিঘা, তেওতা এলাকার কমল বিশ্বাসেী ৩০ বিঘা, আব্দুল বারির ২০ বিঘা ও নিবারুণ বিশ্বাসের ২০ বিঘার সম্পুর্ণ বাদাম তলিয়ে গেছে।

হরিরামপুর উপজেলার উজানকান্দি এলাকার বাদাম চাষি সাহেব আলী ও আব্দুর রহমান জনবাণীকে জানান, ‍“তারা প্রায় ১৫/১৬ বছর ধরে বাদাম চাষ করছে। বাদাম চাষ অনেকটা জুয়া খেলার মতো, হলে খুব ভালো, না হলে সব গেলো। অতিরিক্ত খরা ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে না পড়লে বাদাম চাষে লাভবান হওয়া খুব সহজ। জমি চাষ করে শুধু একবার বাদামের বীজ বপন করে আসলেই হয়। অন্যান্য ফসলের মতো এত পরিচর্যা করতে হয় না। সময় মতো শুধু জমি থেকে গাছ তুলে এনে বাদাম ছাড়িয়ে পরিস্কার করে রোদে শুকিয়ে গুদাম জাত করেই কাজ শেষ।

তারা আরও বলেন, বাদাম চাষে ভয় হয় শুধু খরা ও আগাম বন্যার জন্য। বিগত চার বছর আগে আগাম বন্যায় আমাদের জমির বাদাম তলিয়েগেলে একেকজনের প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতি হয়। এ বছর বাদামের বাজার ভালো থাকলেও সময়ের চেয়ে আগে পানি চলে আসায় আমাদের অধিকাংশ বাদাম তলিয়ে গেছে, যতটুকু বাদাম তুলতে পেরেছি তার ফলনও ভালো হয়নি।”

দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া, বাচামারা, জিয়নপুর ও চরকাটারি ইউনিয়নের চরগুলোতে নতুন মাটি পড়ায় প্রতিবছর বাদামের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকরা ব্যাপকহারে বাদাম চাষ করে থাকে। জেলার সিংহভাগ উৎপাদন দৌলতপুরেই হয়ে থাকে। কিন্তু এবারের আগাম বন্যায় কৃষকদের অধিকাংশ বাদাম তলিয়ে গেছে।

বাসাইল এলাকার শাহিদা বেগম জানান, “আমি সারে ৩ বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছি যার অর্ধেক তলিয়ে গেছে, একই এলাকার হবিবর জানান ৮বিঘা বাদাম চাষ করে তিন বিঘা ঘরে আনতে পেরেছি বাকি পাঁচ বিঘাই তলিয়ে গেছে।”

নদী পারের জমিতে অন্যান্য ফসলের চেয়ে বাদাম চাষ বেশ সহজলভ্য কম পরিশ্রমে অধিক ফলন হওয়ায় লাভও বেশি হয়। তাই প্রতিবছরই বাদাম চাষ করেন থাকেন এসব এলাকার কৃষকেরা। প্রতি বিঘা জমিতে বাদাম চাষে সবমিলে খরচ প্রায় ৫/৬ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ৬ মণ বাদাম পাওয়া যায়। প্রতি মণ বাদামের বর্তমান বাজারদর প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। সেই হিসেবে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ২৪/২৫ হাজার টাকার বাদাম বিক্রি করা যায়। বাদামের গাছগুলোর জ্বালানি হিসেবেও বেশ চাহিদা রয়েছে। চরাঞ্চলের জমিগুলোতে অন্যান্য ফসলের চেয়ে তাই বাদাম চাষই বেশ লাভজনক।

শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের ৯ং ওয়ার্ড মেম্বার মজনু শেখ জানান, “নদী এলাকায় ফসলের আবাদ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোন সময় নদীর ভাঙন শুরু হলে ফসলের জমি চলে যায় নদীগর্ভে। তাই অল্প খরচে বাদাম চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ আরও বেশি। কিন্তু এবারে বন্যার পানি আগে চলে আসায় কৃষকদের ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”

এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আবু মো. এনায়েত উল্লাহ জনবাণীকে বলেন, “ভাঙন ও আকস্মিক বন্যা হওয়ায় বাদাম উৎপাদন গত বছর ৩৪৮৫ হেক্টর হলেও এবছর ২৮৫০ হেক্টর হয়েছে। যা আমাদের লক্ষ মাত্রার চেয়ে ৬৩৫ হেক্টর কম। আমরা আগামীতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক ও নতুন বাদামের বীজ আমদানি করেছি যেমন “বারি চিনাবাদাম ৮” অল্প খরচে অধিক বাদাম উৎপাদনে কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ এসব বীজ দিয়ে সহায়তা করা হবে। যারা ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের তালিকা রাখা হচ্ছে, অফিসিয়াল ফান্ড এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদেরকে প্রথম এ কর্মসূচির ভেতর নিয়ে আসা হবে।”

এসএ/