১৩ বছর আগে যেভাবে উদ্ধার হয় ‌‘এমভি জাহান মনি’র ২৬ নাবিক


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:০২ অপরাহ্ন, ১৪ই মার্চ ২০২৪


১৩ বছর আগে যেভাবে উদ্ধার হয় ‌‘এমভি জাহান মনি’র ২৬ নাবিক
ফাইল ছবি

মোহাম্মদ এরশাদ, চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টায় চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ব্রেভ রয়েল শিপিংয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে একটি জরুরি ফোনকল আসে। ভারতের লাক্ষা দ্বীপ থেকে ১৭০ নটিক্যাল মাইল (এক নটিক্যাল মাইল ১ হাজার ৮৫২ মিটারের সমান) দূরে আরব সাগরে অবস্থানরত জাহাজ ‘জাহান মণি’ থেকে আসা সেই ফোনকলে জানানো হয়, সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজটি দখল করে নিয়েছে। ১০০ দিনেরও বেশি সময় পর চট্টগ্রামে ফিরে মুক্ত নাবিকেরা স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। 


চট্টগ্রামের ব্রেভ রয়েল শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’ ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর যাত্রা শুরু করেছিল ইন্দোনেশিয়া থেকে। এর মধ্যে একবার জাহাজটি সিঙ্গাপুর বন্দরে যাত্রাবিরতি করে। ২৭ নভেম্বর রওনা হয় গ্রিসের উদ্দেশে। এর মাত্র নয়দিন পর ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ৪৩ হাজার ১৫০ টন নিকেল আকরিক বহনকারী জাহাজটি হঠাৎ ছিনতাইয়ের শিকার হয় আরব সাগরে। জাহাজটির নির্ধারিত যাত্রাপথ ছিল সুয়েজ ক্যানালের ভেতর দিয়ে। কিন্তু ছিনতাইয়ের পরপরই জাহাজটির গতিপথ সোমালিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। জাহাজটিতে তখন মোট ২৬ জন বাংলাদেশী নাবিক বা কর্মী ছিলেন, এদের মধ্যে একজন ছিলেন সপরিবারে। এরপর প্রায় সাত দিন জাহাজটির কারও সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা যায়নি। ছিনতাই হওয়ার পর জাহাজটির কলসাইন ছিল এস-২০ভি।


আরও পড়ুন: সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করতে পারেনি বাংলাদেশ


সাতদিনের মাথায় সোমালিয়ায় নোঙর

বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ ‘এম ভি জাহান মণি’ ছিনতাই হওয়ার সাতদিনের মাথায় ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত দেড়টা নাগাদ পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া উপকূলে গিয়ে ভিড়ে। ওই সময় উপগ্রহচিত্র থেকে দেখা যায়, জাহাজটি এখন সোমালিয়ার জলসীমার ভেতরে উপকূল থেকে সাত মাইল দূরে গারাকাড নামক স্থানের কাছাকাছি নোঙর করেছে। মূলত তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সোমালিয়ার জলদস্যুরাই জাহাজটি ছিনতাই করেছে।


৯ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ চাইলো দস্যুরা

২০১০ সালের ১৩ ডিসেম্বর সোমালিয়ার জলদস্যুরা তাদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী নাবিকদের ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে মুক্তিপণ দাবি করে। লিওন নামের একজন জলদস্যুদের পক্ষে দরকষাকষি করছিলেন। তিনি নাবিকদের জানান, জলদস্যুরা ৯ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ চায়। এ ব্যাপারে জলদস্যুদের পক্ষ থেকে জাহাজমালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মণিতে থাকা ২৬ জন বাংলাদেশির সবাই তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ২ থেকে ৪ মিনিট কথাও বলেন। ওই সময় জাহাজটির সেকেন্ড অফিসার মোহাম্মদ নুর ই আলমের স্ত্রী মাহবুবা ইয়াসমীন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, জলদস্যুরা ৬৫ কোটি টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে বলে স্বামীর সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন।


স্যাটেলাইট ফোনে আলোচনা শুরু

ব্রেভ রয়েল শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল করিম ওই সময় সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘ছিনতাই হওয়ার পর ১২ ডিসেম্বর জলদস্যুরা তাদের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছাড়াও নাবিকদের সঙ্গেও কথা হয়। এরপর থেকে দস্যুদের সঙ্গে স্যাটেলাইট ফোনে প্রায় নিয়মিতই মুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।’ ছিনতাই হওয়ার পর থেকে জাহাজ মালিকপক্ষ জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে। অন্যদিকে নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। ২৪ ডিসেম্বর জাহাজের ক্যাপ্টেন ফরিদ আহমেদ ব্রেভরয়েল শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল করিমকে ফোনে জানান, পরিস্থিতি ভয়াবহ। জাহাজের বিশুদ্ধ খাবার পানি ও জ্বালানি শেষ হয়ে যাচ্ছে।


দরকষাকষি শেষে ৮৫ দিন পর লিখিত চুক্তি

২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ব্রেভ রয়েল শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দরকষাকষি বা নেগোশিয়েশন চূড়ান্ত হয়। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি জলদস্যুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুক্তির বিষয়ে লিখিত চুক্তি হয়। সমঝোতা অনুযায়ী জলদস্যুরা এমভি জাহান মণিকে ওমানের সালালাহ বন্দর পর্যন্ত যাওয়ার মতো জ্বালানি তেল এবং নাবিকদের খাওয়া-দাওয়া ও কিছু ওষুধপত্র সরবরাহ করে। ১১ মার্চ ব্রেভ রয়ালসের মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল করিম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, জলদস্যুদের সকল দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার পরেই জাহাজটিকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় কেউ মধ্যস্থতা করেনি। গত তিন মাস ধরে তাদেরকেই নাবিকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে হয়েছে।’


বিমান ওড়ে যায় স্যুটকেসভর্তি ডলার নিয়ে

১২ মার্চ একটি ছোট বিমান সোমালিয়া উপকূলের উদ্দেশে ওড়ে যায়। সেখানে সোমালিয়ান জলদস্যুদের বহনকারী একটি স্পিডবোটে বিশেষ কৌশলে দুটি ওয়াটারপ্রুফ স্যুটকেস ছুঁড়ে দেওয়া হয়। যা ছিল ১০০ ডলারের নোটের বান্ডিলে পূর্ণ। পরে জাহাজটির ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ জানান, সেই স্যুটকেসে মুক্তিপণের টাকা পেয়ে জলদস্যুরা আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মুক্তিপণ হিসেবে নগদ ৪ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪০ কোটি টাকা) এবং জ্বালানি খরচ বাবদ আরও ১ লাখ ডলার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল জলদস্যুদের। এরপরই সবুজ সংকেত আসে জলদস্যুদের কাছ থেকে।


মুক্তি মিললো ১০০ দিনের মাথায়

অবশেষে ছিনতাইয়ের ১০০ দিনের মাথায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ সকাল ১০ টা ২৫ মিনিটে নাবিক এবং জাহাজটি জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হয়। জাহাজটি নাবিকদের নিয়ে সোমালিয়ার উপকূলীয় গ্রাম গারাকাড থেকে ওমানের সালালা বন্দরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। সোমালিয়ার জলদস্যুরাই নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে জাহাজটি সেখানকার জলসীমা পার করে দেয়, যাতে তারা আবার জলদস্যুদের কবলে না পড়েন। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ ব্রেভ রয়েল শিপিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘কূটনৈতিক সফলতার মধ্য দিয়ে জাহাজ ও এর নাবিকদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে মুক্ত করা গেছে।’ মুক্তিপণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মালিকপক্ষ থেকে কোনো মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি এবং আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না।’ তবে ১৮ মার্চ জাহান মণি’র মালিকপক্ষ ব্রেভ রয়েল শিপিং ম্যানেজমেন্ট (বিডি) লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মেহেরুল করিম সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘২৮ কোটি টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুরা নাবিকদের ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে।’


মুক্তির আনন্দ নিয়ে ওমান থেকে চট্টগ্রাম

মুক্তির সাতদিন পর ওমান এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে নাবিকরা ওমানের সালালাহ থেকে ২১ মার্চ বিকাল তিনটা ২৮ মিনিটে সরাসরি চট্টগ্রাম পৌঁছান। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে মুক্ত নাবিকদের স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এবং নাবিকদের স্বজনরা। এ সময় ভিআইপি লাউঞ্জে এক আবেগঘন পরিবেশের অবতারণা হয়। লাউঞ্জে আসার পরপরই মুক্ত নাবিকেরা স্বজনদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জাহান মণির চিফ ইঞ্জিনিয়ার মতিউল মাওলা জিম্মি ছিলেন স্ত্রী রোখসানা গুলজারসহ। মতিউল মাওলা পরে বন্দি থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লিখেছেন।


আরও পড়ুন: জলদস্যুরা যোগাযোগ না করা পর্যন্ত আলোচনার সুযোগ নেই: কেএসআরএম


১০০ দিনে ক্ষতি ২৮ লাখ ডলার

সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ছিনতাই হওয়া জাহাজ মুক্ত করতে সাধারণত ১৪৩ দিনের মতো সময় লাগে। কিন্তু ‘জাহান মণি’ উদ্ধারে সময় লেগেছে মাত্র ৯৮ দিন। এরপরও সবিমিলিয়ে ১০০ দিন আটকে থাকায় জাহাজমালিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ লাখ মার্কিন ডলার। এছাড়া ওমানে নাবিকদের ভিসাসহ অন্যান্য কাজে ৮ লাখ মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে।

সেই ‘এমভি জাহান মণি’ এই মুহূর্তে সিঙ্গাপুরের পথে

সেই ‘এমভি জাহান মণি’ এখনও চলছে সগৌরবে। ১৯০ মিটার দীর্ঘ ও ৩২.২৬ মিটার প্রস্থের জাহাজটি বর্তমানে সিঙ্গাপুর বন্দরের উদ্দেশ্যে ১০.৪ নটিক্যাল গতিতে যাত্রা করছে। আগামী ১৬ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টায় সেখানে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাপানের সাইকাইয়ে ১৬ বছর আগে ২০০৮ সালে ওশিমা শিপবিল্ডিং কোম্পানির তৈরি ‘জাহান মণি’ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগ্রুপ কবির গ্রুপের মালিকানায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের পতাকা বহন করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। এটি আগে অ্যাস্টন ট্রেডার ও জিন পু নামেও পরিচিত ছিল।


জেবি/এজে