রাজনীতিতে চার দশকের বেশি, খালেদা জিয়ার দীর্ঘ পথচলা

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি দীর্ঘ ও প্রভাবশালী অধ্যায়ের অবসান হলো।
গৃহবধূ থেকে দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রী হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন টানা ৪১ বছরেরও বেশি সময়। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একই দায়িত্বে বহাল ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি কোনো আপসে যাননি বলে দলীয়ভাবে দাবি করা হয়। বারবার গৃহবন্দি ও অন্তরীণ হওয়া সত্ত্বেও আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরবর্তী আট বছরে তাকে সাতবার অন্তরীণ করা হলেও আন্দোলনের ময়দান থেকে সরে যাননি খালেদা জিয়া।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে গভীর ব্যক্তিগত শোকের মধ্য দিয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি সাংগঠনিক সংকটে পড়ে। সেই সময় গৃহবধূ খালেদা জিয়া সামনে এগিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন: শেষ সময় যারা ছিলেন খালেদা জিয়ার পাশে
বিজ্ঞাপন
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই, ১৯৮৩ সালের মার্চে, হন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। একই বছরের ১ এপ্রিল বিএনপির বর্ধিত সভায় তিনি প্রথমবারের মতো বক্তব্য দেন। বিচারপতি সাত্তারের অসুস্থতার সময়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি তিন দফায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন—১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সরকার গঠন করে বিএনপি। তার নেতৃত্বেই সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটে।
বিজ্ঞাপন
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর তিনি ষষ্ঠ সংসদে মাত্র এক মাস প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলে তিনি বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব নেন।
২০০১ সালে চারদলীয় জোটের নেতৃত্ব দিয়ে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এই জোটে ছিল জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া কখনোই সরাসরি কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে তিনি একাধিক আসনে প্রার্থী হয়ে সবগুলোতেই জয়লাভ করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হন।
বিজ্ঞাপন
তবে ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় ২০১৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেননি তিনি। ২০২৪ সালের নির্বাচনও বিএনপি বয়কট করে। ফলে ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচনের বাইরে ছিলেন খালেদা জিয়া। ২০২৬ সালের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে তার অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয়নি।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩৭২ দিন কারাবন্দি থাকার সময় তার মায়ের মৃত্যু হয়। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে মায়ের মরদেহ দেখে তিনি ভেঙে পড়েন।
বিজ্ঞাপন
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় আবারও কারাগারে যেতে হয় তাকে। প্রায় দুই বছর পর করোনাকালে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। পরবর্তীতে একাধিকবার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২৫ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতায় তাকে সম্পূর্ণ দণ্ডমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
খালেদা জিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট। তার জন্মস্থান দিনাজপুর জেলার জলপাইগুড়ি এলাকা। বাবা ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ব্যবসায়ী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
তিনি দুই সন্তানের জননী—তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো।
বিজ্ঞাপন
জাতীয়তাবাদী ধারার বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খালেদা জিয়ার অবদান উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মতে, তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, যিনি নির্বাচনের মাঠে কখনো পরাজিত হননি।
চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী এই নেত্রীর মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে এক শূন্যতা, যার প্রভাব দীর্ঘদিন অনুভূত হবে।








