প্রান্তিক খামারিদের দোরগোড়ায় ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার

ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারের মাধ্যমে দুধ পরিক্ষা করছে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প। প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিদের দোরগোড়ায় দুধের মান নির্ণয়ের লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে পরীক্ষাগার নির্মাণ করেছেন গাজীপুর কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ডেইরি ও পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদুর রহমান।
বিজ্ঞাপন
প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি পরীক্ষাগার তৈরি করতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জায়গা ও জনবলের প্রয়োজন হয়। আবার সকল শ্রেণির জনগোষ্ঠীকে সেবা প্রদান করাও অনেক সময় সম্ভব হয় না। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার এই সমস্যাগুলোর সমাধানে একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে ভাবনার সাথে দেশের যুব সমাজকে যুক্ত করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ক্ষেত্রে সোলার সিস্টেম ব্যবহার করার কথা ভাবা যেতে পারে। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারকে আপগ্রেড করে ভ্রাম্যমাণ ফুড ল্যাব করা যেতে পারে। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার কথা চিন্তা করে এ ধরণের ল্যাব পরিচালনার ব্যয় সকল স্টেকহোল্ডার সম্মিলিতভাবে বহন করতে পারেন। তবে ল্যাব পরিচালনা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বিজ্ঞাপন
সাফল্যের সাথে ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে বাংলাদেশে উৎপাদিত দুধের গুণগত মান সম্পর্কে জাতীয় ডাটাবেজ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও মাঠ পর্যায়ে প্রাণি থেকে নিঃসরিত গ্রীণ হাউজ গ্যাস পরিমাপে অন-সাইট দুধ বিশ্লেষণে ভূমিকা রাখতে পারবে। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়। এতে করে অদূর ভবিষ্যতে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য দেশের বাইরে রপ্তানি করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার ব্যবহার করে স্টেকহোল্ডারের সুবিধামতো স্থানে প্রশিক্ষণ বা সচেতনতা তৈরির জন্য প্রচারণা চালানো যাবে। অডিও-ভিজ্যুয়াল সহ অফলাইন ও অনলাইনে সংশ্লিট ব্যক্তিবর্গ যুক্ত হওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার এ সাথে থাকা মনিটরের সাহায্যে স্টেকহোল্ডারগণ Real-Time সব নমুনা পরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন এবং তাঁদের প্রদত্ত নমুনার বেশিরভাগের ফলাফল-ই জানতে পারবেন। এতে করে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে "ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে" পরীক্ষা সম্পর্কে আস্থা তৈরি হবে। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার অবস্থান শনাক্ত করার জন্য GPS ট্র্যাকিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ল্যাবের ভেতরে রয়েছে সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট সুবিধা।
বিজ্ঞাপন
ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে রয়েছে অটোমেটেড মিল্ক এনালাইজার যা দিয়ে গরু ও মহিষের দুধের ফ্যাট, প্রোটিন, ল্যাকটোজ, তাপমাত্রা, সলিডস নট ফ্যাট (এস.এন.এফ) ঘনত্ব, দ্রাব্যতা (সলিউবিলিটি), হিমাংক (ফ্রিজিং পয়েন্ট) নির্ণয় করা যাবে। দুধে পানি যোগ করা হয়েছে কি না, ফরমালিন, ইউরিয়া, সোডা, লবণ, চিনি বা স্টার্চ এর সংমিশ্রণ রয়েছে কি না তা জানা যাবে। বর্তমানে ম্যানুয়ালি পরীক্ষা করা হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্রুততার সাথে দুধে ভেজাল নির্ণয় করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে মোট ১৪ ধরনের ভেজালের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। দুধে মোট ২৭ টি এন্টিবায়োটিক-এর রেসিডিউ নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে বা উপরে আছে কি না তা জানা যাবে দ্রুততার সাথে।
ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে রয়েছে বায়োসেফটি কেবিনেট-১, ইনকিউবেটর এবং রেডিমেট কালচার মিডিয়াম সিস্টেম। ফলে দুধে উপস্থিত ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাসের সংখ্যা জানা যাবে অনায়াসেই। ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে" অত্যাধুনিক সোমাটিক সেল কাউন্টারের সাহায্যে দুধে বিদ্যমান সোমাটিক সেলের সংখ্যা নির্ণয় করে দুধের গুণগত মান এবং খামারের গাভীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে সহজেই।দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্যে (যেমন-ঘি) দুধের চর্বি ছাড়া অন্য কোন চর্বি মেশানো হয়েছে কি না তা নির্ণয় করা যাবে ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগারে বিউটারো রিফ্রাক্টোমিটারের সাহায্যে।
গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানান, এটি শুধুই একটি ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষাগার নয়। কারণ, ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করার পাশাপাশি জনসচেতনতা তৈরি, প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানে ভূমিকা রাখতে পারবে। এধরনের ল্যাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য সম্পর্কিত জাতীয় ডাটাবেজ তৈরি করা সম্ভব হবে যা ব্যবহার করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আগাম ধারণা করা বা প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হবে। এছাড়াও, ভ্রাম্যমাণ দুধ পরীক্ষাগার অহেতুক গুজব বা ভীতি ছড়ানোর পরিবর্তে খামারী, পণ্য প্রস্তুতকারী এবং ভোক্তার মধ্যে একটি মেল বন্ধন তৈরি করবে যাতে করে সকল পক্ষই লাভবান হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
দুধ মানব দেহের জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রাকৃতিক খাদ্য। কিন্তু দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে যদি না দুধের গুণগত মান সঠিক থাকে। গাভীর খাদ্য শারীরিক অবস্থা, দুধ সংগ্রহ, পরিবহন ও সংরক্ষণ, পরিবেশ ইত্যাদি সম্পর্কে পর্যান্ত জ্ঞানের অভাব এবং অসাধুতা হতে পারে দুধের গুণগত মান পরিবর্তনের কারণ। এ কারণেই সঠিকভাবে নিয়মিত দুধের গুনাগুণ নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরী। বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্প একটি বিকাশমান খাত। গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ২.৫ গুণ। দুগ্ধ শিল্পের এই বিকাশের পেছনে বিশাল অবদান রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের দুগ্ধ খামারিদের।
দেশের উৎপাদিত দুধের সিংহভাগ ভোক্তার কাছে পৌঁছায় অনানুষ্ঠানিক বাজারের মাধ্যমে। ফলে এসকল দুধ এবং সেখান থেকে উৎপাদিত দুগ্ধজাত দ্রব্যের মান সম্পর্কে জানা হয়ে ওঠে না। আবার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুধের মান যাচাইয়ের সুযোগও থাকে না। ফলে ভোক্তা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উৎপাদনকারীও স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রয়োজন একটি টেকসই মডেল যাতে করে উৎপাদনকারী এবং ভোক্তার মধ্যে দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের গুণগত মান নিয়ে এক ধরনের আস্থার সেতু বন্ধন গড়ে ওঠে। দুধের গুণগত মান পরীক্ষা নিয়ে অহেতুক ভীতির পরিবর্তে এটি যে দুগ্ধ শিল্পের জন্য লাভজনক সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াও অত্যন্ত জরুরী। এছাড়াও উৎপাদনকারীর দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করাটাও প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে ২০১৯ সাল থেকে ৫ বছর মেয়াদি দেশের ৬১ জেলার ৪৬৫ উপজেলায় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। নিরাপদ প্রাণী ও প্রাণীজাত পণ্য উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য।








