অভ্যন্তরীন কোন্দলে অস্বস্তিতে ময়মনসিংহ বিএনপি
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩:১৪ পূর্বাহ্ন, ৪ঠা অক্টোবর ২০২২
ময়মনসিংহে অভ্যন্তরীন কোন্দল মিটিয়ে সম্মিলিত শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে পারছে না বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। দীর্ঘ দিন ক্ষমতার বাইরে থেকে নির্যাতন নিপীড়নে মাঠের নেতাকর্মীরা পর্যুদস্ত হলেও ত্যাগী নেতাদের বিবেচনার বাইরে রেখে কতিপয় পছন্দের লোক নিয়ে কমিটি পূর্ণ করার অভিযোগ রয়েছে। নিজেদের ভেতরের কাদা ছুড়াছুড়ি বন্ধ হয়নি। নিজেদের আভ্যন্তরীন ভেদাভেদে অনেক শাখাতেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ জেলায় বিএনপি ৩টি ইউনিটে বিভক্ত। এর মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা, ময়মনসিংহ উত্তর জেলা এবং ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপি।
প্রায় দুই বছর আগে এই ইউনিটগুলোতে বিএনপির পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হলেও এখন পর্যন্ত গঠিত জেলা ও মহানগর কমিটি তাদের অধীনস্থ কমিটি গঠনে সফলতার মুখ দেখাতে পারেননি দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। প্রায় এক বছরের অধিক সময়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপি সম্মেলন না করে মাত্র ৪টি উপজেলা কমিটি গঠন করেছে। সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তবে দলের একটি শক্তিশালী অংশকে এসব কমিটি থেকে মাইনাস করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে ত্রিশাল উপজেলা ও পৌর কমিটি নিয়ে ক্ষোভ অসন্তোষ থেমে থেমেই জ্বলে উঠছে বারবার। এসব আভ্যন্তরীন কোন্দল প্রায়শই প্রকাশ্যে অপ্রীতিকর ঘটনার রুপ নিতে দেখা যায়।
ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনে ডা. মাহাবুবুর রহমান লিটন নিজের অবস্থান শক্ত করে ধরে রাখার জন্য তার নিজ অনুগতদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করেছেন বলে দলের মাঠ পর্যায়ের ত্যাগী ও পদ বঞ্চিত নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে। এখানে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে বিএনপি দলীয় সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে। এক সময় দলের মাঠ কাপানো ত্যাগী এসব নেতাকর্মীদের রয়েছে হাজার হাজার অনুসারী। যাদের ভেতর চরম অসন্তোষ ও হতাশা বিরাজমান।
ত্রিশাল উপজেলার উপজেলা পরিষদের সাবেক সফল চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনের হাজারো সমর্থক কর্মী দলে তার স্বমূর্তিতে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছেন। সরেজমিনে মাঠে গেলে বিষয়গুলো স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। শক্তিশালী আওয়ামী লীগের সাথে ত্রিশালে বিএনপিকে সবসময়ই যুদ্ধ করে চলতে হয়। সেখানে জয়নাল আবেদীনের মত নেতাকে গুরুত্বহীন করে রাখা দলের জন্য অশনি সংকেত বলেই মাঠের কর্মীদের অভিমত।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে মুক্তাগাছা উপজেলাতেও। সেখানেও এরশাদ বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময় মাঠ কাপানো তুখোর ছাত্র নেতা, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সাম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ এসএম জাকারিয়া হারুন দলের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই তাকে বাদ দিয়ে ওয়ান ইলেভেনের সময় দল থেকে পদত্যাগ করা এবং বিএনপিকে আগুন সন্ত্রাসীর দল হিসেবে মন্তব্য করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে সুম্পর্ক বজায় রেখে চলা ইউনিয়ন বিএনপির এক সাবেক সভাপতিকে উপজেলা বিএনপির আহবায়ক এবং অপর এক ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি যুগ্ম আহবায়ক করে দলের দ্বিতীয়, তৃতীয় সারির নেতাদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। সেখানে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম শাহরিয়ার শরীফ, পৌর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক কমিশনার আকরাম আলী ভুলুসহ দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে কৌশলে মাইনাস করে গঠন করা হয়েছে নতুন কমিটি। এসবের প্রতিবাদে দলের ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতা-কর্মীরা একাদিক বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। তারা বিষয়টি কেন্দ্রে লিখিতভাবে জানিয়েও কোন প্রতিকার না পেয়ে হাজার হাজার কর্মী সমর্থক নিয়ে অনেকটাই নিরব-নিস্প্রভ হয়ে গেছেন।
বঞ্চিতদের অভিযোগ মুক্তাগাছা থেকে দুইবার নির্বাচন করে পরাজিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক জাকির হোসেন বাবলু একক কর্তৃত্ব বজায় রেখে পছন্দের লোকদিয়ে ঢাকা থেকে দল চালাচ্ছেন। নেতাকর্মীদের অভিযোগ সেখানে কোন্দল মিটাতে না পারলে বিএনপির ভাল ফল প্রত্যাশা দূরাশা হয়ে দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির অধীনস্থ গফরগাঁও ও ফুলবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির নতুন কমিটি গঠন করা হলেও নেতৃত্ব বাঁছাই নিয়ে রয়েছে চরম বির্তক।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা বিএনপিতে পুরোপুরি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজমান। ত্যাগী সিনিয়র নেতাদেরকে বঞ্চিত তরে সুবিধাবাদীদের প্রাধান্য দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে দল।
ফুলবাড়িয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট আজিজুর রহমান, আন্দোলন সংগ্রামে বরাবর সরব উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশিকুল হক আশিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বালিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান পলাশ, ময়মনসিংহ জেলার হাজার-হাজার বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা করা জেলা বিএনপির সদস্য এডভোকেট রেজাউল করিম চৌধুরী, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রনেতা অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন বাদশা, উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রদলের সভাপতি মাসুদ আহমেদ মাসুদসহ সিনিয়র নেতা-কর্মীদেরকে উপজেলা কমিটিতে যোগ্য স্থানে না রেখে চরম অমূল্যায়ন করা হয়েছে। স্থানীয় বিএনপির প্রাণভোমরা এসব নেতাদেরকে কোনঠাসা করে রেখে জুনিয়র এবং কতিপয় নেতাদের পছন্দসই সুবিধাবাদীদের গুরুপূর্ণ অবস্থানে রেখে কমিটি করা হয়েছে বলে বঞ্চিত নেতাকর্মীদের অভিযোগ। এসব নিয়ে চরম হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে মাঠ পর্যায়ে।
অপরদিকে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টারদা সূর্যসেন হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম সরকারও বঞ্চিত হয়েছেন। আব্দুল করিম সরকারের নেতৃত্বে ১৩ টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটি ওয়ার্ড বিএনপিসহ, ছাত্রদল, যুবদল দল, স্বেচ্ছাসেবক দলের একাংশ, মৎস্যজীবী দলের নেতাকর্মীদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতা করিম সরকারের গ্রুপকে বঞ্চিত করেছে জেলা বিএনপি। প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ১/১১’র ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকারের সময় কিডস পার্টি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল পিডিপি করা এক নেতাকে। পিডিবি থেকে সদ্য বিএনপিতে আসা আক্তারুল আলম ফারুককে আহবায়ক করে ফুলবাড়িয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি করা হয়েছে। সেই কমিটিতে সিনিয়রদের অবমূল্যায়ন করে জুনিয়রদের গুরুত্ব দেয়ায় মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে চরম ক্ষোভ রয়েছে। এখন সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে কথিত নেতার নেতৃত্বে থাকা বিএনপিকে বড়বেশি মাঠে পান না বলে অভিযোগ তৃণমূলের কর্মীদের। ফুলবাড়িয়ার শত শত বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও আহবায়ক ফারুকের বিরুদ্ধে কোন মামলা না হওয়ায় মাঠের নেতাকর্মীরা অভিযোগের সুরে বলেন তিনি হয়তো সরকারী দলের সাথে গোপন আতাঁত করে চলেন।
এ ব্যাপারে মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আবু ওয়াহাব আকন্দ ওয়াহিদ বলেন, শিগগিরই বাকি ওয়ার্ডগুলোর কমিটি দেওয়া হবে।
এদিকে র্দীঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সাংগঠনিকভাবে চরম বাজে অবস্থায় চলছে ময়মনসিংহ জেলা উত্তর বিএনপি। গত ৫ বছর ধরে বিএনপির সাংগঠনিক এই জেলার প্রায় বেশির ভাগ উপজেলা বিএনপি চলছে দুই কমিটি দিয়ে।
মাস দুই আগে গঠিত হয়েছে ৬৭ সদস্য বিশিষ্ট ময়মনসিংহ জেলা উত্তরের নতুন কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন গত প্রায় ২০ বছর ধরে বিএনপির কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকা অধ্যাপক এনায়েত উল্লাহ কালাম।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপির নেতারাই দলটিকে নষ্ট করে দিচ্ছে। গত ৫ বছর ধরে ঈশ্বরগঞ্জ বিএনপি চলছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে। এর একটি পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন ময়মনসিংহ-৮ ঈশ্বরগঞ্জ আসনের সাবেক এমপি শাহ নূরুল কবীর শাহীন এবং অপর একটি অংশের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী লুৎফুল্লাহেল মাজেদ বাবু। উপজেলা থেকে শুরু করে প্রতিটি ইউনিয়নে রয়েছে তাদের আলাদা আলাদা কমিটি। এতে দল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও জানান ঐ বিএনপি নেতা।
একই ধরনের অবস্থা বিএনপির সাংগঠনিক এই জেলার নান্দাইল, হালুয়াঘাট, ফুলপুর, তারাকান্দা, গৌরীপুর ও ধোবাউড়া উপজেলার। এই সবকটি উপজেলাতেই বিভক্ত হয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
দলীয় বিভক্তি, কমিটি গঠনে অনিয়ম এবং বিতর্কিতদের কমিটিতে অর্ন্তভুক্তিসহ দলের অবস্থানের বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, কমিটি করতে গেলে সবাইকে তো আর সব পদ দেওয়া যাবে না। তবে সবাইকে নিয়েই বিএনপির কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
এদিকে জেলা বিএনপিকে শক্তিশালী করতে দলের সকল বিভেদ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি গঠনের দাবী জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
জেবি/ আরএইচ/