নারীর প্রতি কটুক্তি, বৈষম্যমূলক আচরণ ও সামাজিক মূল্যবোধ


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


নারীর প্রতি কটুক্তি, বৈষম্যমূলক আচরণ ও সামাজিক মূল্যবোধ

নারীর প্রতি কটুক্তি ও বৈষম্য বর্তমান সময়ের নয় অবিভক্ত ভারতবর্ষ বা এরও আগের থেকে বিরাজমান। আজ থেকে দুইশত বছর আগে ভারতবর্ষে কিছু রাজ্যে ‘স্তন কর’ বা ‘Breast Tax’ প্রচলিত ছিল, ব্রাহ্মণ ব্যতিত অন্য কোনো হিন্দু নারীর স্তনকে ঢেকে রাখার অধিকার ছিল না। কোনো নারী স্তনকে আবৃত করতে চাইলে, তাকে স্তনের আকারের উপর নির্ভর করে ট্যাক্স দিতে হতো। সাধারণপূর্বাব্দ ৫০০ শতকে সমাজে প্রচলিত ছিল, নারী শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী বার্ধক্যে পুত্রের অভিভাবকত্বে থাকবে, নারী স্বয়ংশাসিত থাকতে পারবে না। মধ্যযুগে বাল্যবিবাহ এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা চালু ছিল। মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সাথে সাথে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে, নারীর গতিবিধি বাড়ির অন্দরমহলেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পরিবারে নারীরা তাদের অবস্থান থেকে প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছাড়া অন্য আইনগত অথবা সামাজিক মর্যাদা, সম্পত্তির উত্তরাধিকারী থেকে বঞ্চিত হয়। বিধবা নারী বিবেচিত হলো অমঙ্গলসূচক এবং তাদের জন্য অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ ছিল। তখন নারীদের অর্থনৈতিক উৎপাদনে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য কোন অংশগ্রহণের অধিকার ছিল না। সেসময়ে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে নারীদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে অনীহা ছিল। মিশনারিরা বাংলায় ১৮১৯ সালে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৭৩ সালে কুমিল্লায় প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

 নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গড়ে উঠে নারী সংগঠন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ সরকারের পুষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয় অল পাকিস্তান উইমেন অ্যাসোসিয়েশন । বাংলায় ১৯৪৮ সালে নারীরা বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ এবং বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের সম্মতি প্রভৃতি বিষয়ে শাসনতন্ত্রে বিধান প্রণয়নের প্রস্তাব তুলে ধরে। এ প্রস্তাব গৃহীত হয় নি, বরঞ্চ নারী আন্দোলন সরকার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৬ মে মাসে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠিত হয়। কিন্তু সরকার বিরোধী কর্মকান্ডের অজুহাতে এ সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পরবর্তীতে বেগম সুফিয়া কামাল, হেনা দাস, লীলা নাগ প্রমুখের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি গঠিত হয়।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নারীর আইনগত অধিকারের বিষয় অধিক গুরুত্ব পায়। ১৯৪৮ সালের বাজেট অধিবেশনে নারীদের কাজের অধিকার ও সুযোগ বৃদ্ধির দাবি উত্থাপিত হয় এবং মুসলিম নারীর ব্যক্তিগত আইনের শরীয়া বিল ১৯৫১ পাস হয়, সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৫৪ সালে সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় বেগম ক্লাব। যৌতুকের সংস্কৃতি নির্মূল, সম্পত্তিতে নারীর সমানাধিকার, নারী শিক্ষা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে এই ক্লাব বেগম পত্রিকার মাধ্যমে। বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে বিয়ে, তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে নারীর অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠিত হয় ১৯৫৫ সালে বেগম জাহানারা শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে ও আইন প্রণয়নের জন্য কমিশন গঠন করা হয় এবং এ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে পারিবারিক আইন ১৯৬১ প্রণীত হয়। এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বহু বিবাহ প্রথা নিষিদ্ধ, বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক, বিয়ের বয়স নির্ধারণ, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়। ১৯৬৩ সালে এ আইন কোনো সংস্কার ব্যতীত জাতীয় পরিষদে গৃহীত হয়।

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে নারীরা সমাজের সকল শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে থাকে। ১৯৭১ সালে সংবিধানে নারীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার সন্নিবেশিত হয়। ১৯৭২ সালে প্রণীত প্রথম ও মূল সংবিধান এবং পরবর্তীতে কয়েকটি সংশোধনীতে নারীদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ও সংরক্ষিত অধিকার দেওয়ার কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংযোজন করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ ধারা অনুসারে সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের মাধ্যমে অভিন্ন সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। ২৮ ধারা রাষ্ট্রকে ‘মহিলা বা শিশু অথবা সমাজের যেকোন পশ্চাদপদ অংশের উন্নয়নের জন্য’ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শনা দিয়েছে। জাতিসংঘ সনদ (UNCEDAW) অনুমোদনের মাধ্যমে নারীদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের বৈষম্যের বিলুপ্তি বিষয়ে সরকার ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। এরপরেও এই ধারা গুলো নারী ও পুরুষের মধ্যকার সমান অধিকার, পৈতিৃক উত্তরাধিকার ও পারিবারিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয় নি। বরং প্রচলিত আইনের অনেক ধারা স্পষ্টত নারীর ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক। যেমন ফৌজদারি আইনে ধর্ষণ একটি যৌন সহিংসতা, কিন্তু একজন মহিলার ক্ষেত্রে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ খুবই কঠিন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এনজিওগুলোর প্রসার ঘটে। এনজিওর হাত ধরে Women in Development (WID) প্রজেক্টের মাধ্যমে পশ্চিমা দাতা দেশগুলো “নারীবাদ”, “জেন্ডার ইস্যু” বা “জেন্ডার ইকুয়ালিটি”র কার্যক্রম শুরু করে। এই সকল তৎপরতা ফলে নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠে। এনজিও গুলোতে নারীর অংশগ্রহণ এবং বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এরপরেও নারীর প্রতি যে বৈষম্য আচরণ তা থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারেনি। যুগ সময় পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই কিন্তু নারীকে পরিপূর্ণ মর্যাদা সম্মান দিতে সমাজ আজও ব্যর্থ । সর্বক্ষেত্রে নারীর প্রতি অবমাননা, বৈষম্য, কটুক্তি বিরাজমান। পর্দা প্রথার অনুশাসনের মাধ্যমে নারীকে বন্দিত্ব দিতে ধর্মগুরু ও সমাজ বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠি তৎপর। নারীর মাসিক বা পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব সময়গুলোতে তাকে ধর্মীয় আচার পালন থেকে বঞ্চিত রাখা হয় ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে। এখনো আমাদের দেশে ১৯৩৭ সালের হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু, বৌদ্ধ নারীরা কোন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়।

১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে নারীর প্রতি সহিংসতাকে নারী-পুরুষ সম্পর্কে একটি অন্যতম সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়। আমাদের দেশে ব্যক্তিক, পারিবারিক বা দলীয় ভাবে নারী নির্যাতন অর্থাৎ বলপূর্বক নারীর উপর শারীরিক, মানসিক অথবা লিঙ্গ নির্যাতন মাত্রা অনেক বেশি। এর মূল কারণ হলো আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নারী পুরুষের অসম সামাজিক অবস্থান ও অসম অধিকার। আমাদের দেশে নারীর অধস্তনতার বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন আইন-কানুন, আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতির মাধ্যমে, যা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নারীর প্রতি সহিংসতায় প্রয়োগ হয়। নারীর প্রতি নীরব সহিংসতা হলো গৃহে অন্তরীণ রাখা, পর্দা প্রথা, অসম উত্তরাধিকার, পরিবার ও সমাজে অধস্তন ভূমিকা এবং বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আচরণ। নারী নির্যাতনের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলোঃ লিঙ্গ নির্যাতন, ধর্ষণ, জখম ও হত্যা, মেয়ে শিশু/ভ্রূণ হত্যা, ফতোয়া, যৌতুক, বিয়ে বা তালাকের কারণে জখম ও হত্যা, ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি ও নারীপাচার। সমাজের নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে এমনকি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়েও নারীর প্রতি অশালীন আচারণ পরিলক্ষিত। সমাজ আর যুগ পরিবর্তিত হয়েছে, রাষ্ট্র আর নতুন সমাজ ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু সমাজের নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। এখনো নারীদের জন্য আলাদা স্কুল ব্যবস্থা চালু আছে। নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে বিভিন্ন বাধা নিষেধ দেয়া হয়। নারী যখন সমাজের এই বন্ধন ভেঙ্গে এগিয়ে আসে, ভূমিকা রাখতে শুরু করে, উন্নত চিন্তা ধারা পোষণ করতে শুরু করে, তখনই তাকে বিভিন্ন অশালীন আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম, ছোট শহর, বড় শহর সর্বক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্য, অশালীন আচারণ, কটুক্তি সামাজিকভাবে বিরাজমান। যারই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের সরকারে আসীন ব্যক্তির কুৎসিত আচারণ। ঢাকা শহরেও উচ্চ শিক্ষিত এবং কর্মজীবি নারী বা লেখক বা প্রগতিশীল বা রাজনৈতিক বা সাংবাদিক নারী অতি সহজেই পুরুষের কুৎসিত আচরনের শিকার হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত নারী পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেয়। কিন্তু নারী সাংবাদিকরা অতি সহজে অশ্লীল আচরণ বা প্রচার বা কটুক্তির শিকার হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে, ২০২১ সালে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩২১ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন নয়জন। ২০২০ সালে জানুয়ারি-আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন এক হাজার ২০৪ নারী। ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী। ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন, তখনই শুরু হয় নারীর পোশাক বিতর্ক, ধর্মীয় অবস্থান, সামাজিক রীতিনীতির প্রশ্ন। এসব বহুমুখী প্রশ্নের পরিবেশে সরকার ধর্ষণের শাস্তি জোরদার করে। ধর্ষণের শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। অব্যাহত প্রতিবাদ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরেও ধর্ষণের হার বাড়ছে, কারণ বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, আর্থ- রাজনৈতিক- সামাজিক প্রভাব এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছার অভাব। আজ ২০২১ সালে নারীদের বেঁচে থাকার, স্বাধীন জীবনযাপনের, মর্যাদার, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের, উপার্জনের অধিকারের কি আসলে যথাযত উন্নত হয়েছে ? এর কারণ নারীর সামাজিক অবনত মৰ্যাদা, আর পুরুষের ওপর মেয়েদের চূড়ান্ত অর্থনৈতিক নির্ভরতা। আজও আমাদের সমাজে নারীর প্রতি উপেক্ষা অত্যন্ত তীব্র। আজও  পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চর্চা হলো নারীরা দর্শনীয় হলেও তাদের নির্বাক হওয়া চাই। নারীরা নিজেরাই সমাজের এই ইচ্ছা অন্তরে ধারণ করে। তাঁরা বিশ্বাস করে এবং মানে যে মর্যাদায় তারা নিচু এবং সমাজে পুরুষের সাথে বিবাদ বিতর্ক অস্বাভাবিক ও অমর্যাদাকর । আমাদের সমাজে ভাষাও পুরুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়, আর নারীকে হেয় করে। নারীকে অবমাননা জন্য শব্দ সৃষ্টি হয়েছে এবং সেগুলোর ন্যায্যতা পেয়েছে। সমাজে ভাষার মাধ্যমেও পুরুষের আধিপত্য বোঝা যায়। পরিশেষে বলা যায়, যুগ বদলেছে, সময় এগিয়েছে, সমাজ পরিবর্তীত হয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সম্মান এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। 

লেখক: অভিজিৎ বড়ুয়া অভি। কথা সাহিত্যিক, কবি ও প্রাবন্ধিক।  

এসএ/