অপূরনীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সময়ের দাবি


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


অপূরনীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সময়ের দাবি

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত মাসের ২১ জানুয়ারি থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিসদ বিভাগ। সেই ছুটি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো দুই সপ্তাহ অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা এক গভীর সঙ্কটের মুখে পতিত হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে ৮ মার্চ ২০২০ সাল থেকে দীর্ঘ ১৮(আঠারো) মাস দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিলো। সরকার পক্ষ বলছিলো আমরা অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছি। ফলে শিক্ষার্থীরা তেমন ক্ষতির মুখে পরেনি। ফলে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালু আছে এবং ভবিষ্যতে স্বশরীরের পাশাপাশি অনলাইনকে প্রসারিত করতে চায়।

করোনার গত ঢেউ গুলোতে দেশের প্রায় ৯৪ ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাশের বাইরে ছিলো বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওঠে এসেছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকগুলো হেতু পাওয়া যায়। যেমনঃ বেশির ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের পরিবার হতদরিদ্র, দিন এনে দিন খাওয়া যাকে বলে হাত চললে পেট চলে, নিম্ন আয়ের, নিম্নমধ্যবিত্ত, কৃষিনির্ভর। যেই শিক্ষার্থীর পরিবার হতদরিদ্র তাঁর বাবা-মা সংসার চলতেই হিমসিম খায়। স্মার্ট ফোন কেনা তাঁদের জন্য আকাশ ছুয়ে দেখার মতো। যার পরিবার দিন এনে দিন খায় সেই পরিবারে স্মার্ট ফোন থাকা কল্পনার বাইরে। আর স্মার্ট ফোন না থাকলে অনলাইনের ক্লাশের দুয়ার বন্ধ, যেমনি করে স্বশরীরে ক্লাশের দরজা বন্ধ। আবার যার পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত, কৃষিনির্ভর তাঁদের একটা কোনোরকমের ত্রিজি ফোন আছে এই ফাইভজি প্রবেশের যুগে। কিন্তু তাঁদের  বাবা মা গভীর রাত জেগে চিন্তা করতে থাকে দিনে দিনে যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে তাতে সংসার চলবে কেমন করে!, ঋণ পরিশোধ করবে কেমন করে! ফসলের জমিতে ফসল লাগাবে কেমন করে! তার উপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে সন্তানের অনলাইন খরচ! এ যেন এক মরার উপর খাঁড়ার ঘা! বিশ্লেষণ করলে আরও অনেক কারণ খুজে পাওয়া যায়। যেমনঃ বেশির ভাগ পরিবারের ডিভাইস কেনার সামর্থ না থাকা, গ্রামে ইন্টানেটের গতি খুবই দুর্বল, প্রত্যেকের বাড়িতে টিভি নাই প্রভৃতি।

গ্রামে প্রায় প্রতিটি পরিবারে এনজিও’র কিস্তি নামক অভিশাপ ঢুবে আছে। এনজিও গুলো কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কেউ জমিতে ফসল ফলায়, কেউবা অটোরিকশা, অটোভ্যান কিনে জীবিকা চালায়, কেউবা ঋণ নিয়ে দেনা পরিশোধ করে, কেউবা বন্ধকী জমি ছোড়ায়। সকালে ঘুম ভাঙ্গার আগেই বাবা মাকে চিন্তায় পড়তে হয় আজকে কিস্তির টাকায় কোথায় থেকে আসবে। কিস্তির অথবা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক-শ্রমিক খেটেখাওয়া মানুষ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওঠে আসছে। 

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয় প্রাইমারি স্কুল থেকে। প্রাইমারিতে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তার ৫ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় টিকে থাকে। বাকী শিক্ষার্থী ঝড়ে পরে। কারণ কি? কারণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন বাণিজ্যিকরণে পরিনত হয়েছে। টাকা যার, শিক্ষা তার এই নীতিতে চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে প্রাইমারিতে যেসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় পুঁজিবাদের জাতাঁকলে পিষ্ট হয়ে খুবই অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট নিতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর তথ্যমতে, ২০১০ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪ জন। ২০২১ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসে ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন। প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পাড় হতে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৯ হাজার ৯৮১ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এইচএসসি পাস করে অনার্সে ভর্তি হয়ে কোর্স শেষ করে সার্টিফিকেট পাবে কতজন শিক্ষার্থী সেটা শুধু মাত্র দেখার অপেক্ষা। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিরামিডের অনুরুপ।

করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরনীয়। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার বদলে সরকার আবারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দীর্ঘ করছে। অথচ দেশের সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছে। বাণিজ্যমেলা থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি অফিস-আদালত, গার্মেন্টস, শপিংমল, শিল্প-কারখানা প্রভৃতি সবকিছু উন্মুক্ত ভাবে চলছে। বই মেলার ঘোষণাও এসেছে। তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে এতো প্রহসন কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে কি শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা বাইরে বেড় হচ্ছেন না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে কি তাঁরা বইমেলার মতো প্রাণের মেলায় যাবেন না? শিক্ষক-শিক্ষার্থী সব জায়গায় অবাধে চরাফেলা করছেন। তবে কি করোনা শুধুই চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চে ও শিক্ষার্থীদের ব্যাগে করোনা ঢুকে  আছে? সবকিছু চালু রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অযৌক্তিক। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাণিজ্য মেলা, ব্যাংক, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, শপিংমল প্রভৃতি জনসমাগম জায়গা বন্ধ ঘোষণা না করে সরকারের কাছে করোনা মোকাবিলার একমাত্র সমাধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসনের নামান্তর।

শিক্ষার মধ্য দিয়ে জাতি উন্নত হয়; শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিনত হয়; শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সঠিক-ভুল বুঝতে পারে, শিক্ষার মধ্য দিয়েই দেশে নেতৃত্ব দেওয়ার নতুন মানুষ গঠন হয়। আর শেখানো কিংবা শেখার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আজ সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে। ফলে অনার্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একই বর্ষে তিনবছর ধরে বসে আছে। ফলে দিনে দিনে বাড়ছে হতাশা। হতাশা আর নিঃসঙ্গ থেকে শিক্ষার্থীরা বেঁচে নিচ্ছে আত্মহত্যা। এক রিপোর্টে ওঠে এসেছে ২০২১ সালে বিগত বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। দিনে দিনে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক বন্ধুসূলভের বিপরীতে বৈরী আচরণের পরিনত হচ্ছে।

বাড়ি থেকে ফেরার সময় পাশের সিটে বসা মধ্যবয়সী মহিলার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। হাতে গণা কয়েকটা ক্লাশ তার মেয়ে পেয়েছে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, শিক্ষকের ক্লাশ না করে পরীক্ষায় বসে রেজাল্ট আর কেমন হবে! উচ্চশিক্ষার জন্য এই অপূরনীয় ক্ষতি কিভাবে কাটিয়ে উঠবে! যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিবে তাঁদেরও একই দশা।
 
দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে তা কিছুটা পুষিয়ে নিতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো বিকল্প নাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সময়ের দাবি। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েন। টানা এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত কোনো অর্থেই ভালো ফল বয়ে আনবে না। দীর্ঘ দুই বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা যখন সব খোলা রাখতে পারছি যখন, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত এবং শিক্ষার্থীদের সাথে একপ্রকার প্রহসন।

লেখক: জাফর হোসেন জাকির, শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, নীলফামারী সরকারি কলেজ।

এসএ/