ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ৯টি ও বিজয়নগর উপজেলায় ৫টি অরক্ষিত বধ্যভূমি
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২:৫২ পূর্বাহ্ন, ৩০শে মার্চ ২০২৩
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন মহকুমা ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলায় পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরোচিত হামলায় অসংখ্য বধ্যভূমি ও বাংকারের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক কবি জয়দুল হোসেনের সাথে কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ৯টি বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি তাঁর গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ বইয়ে ৯টি বধ্যভূমির কথা উল্লেখ করেন।
খ্রিস্টিয়ান মিশন হাউজ বধ্যভূমি, শহরের দক্ষিণে মৌড়াইল মৌজায় অবকাশের পূর্বে খ্রিস্টিয়ান মিশন হাউজ এলাকায় ব্যাপ্টিস্ট চার্চে শতশত নারী-পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করেছিল।
শহরের দক্ষিণ পৈরতলা গ্রামের পশ্চিম-দক্ষিণ প্রান্তে রেলব্রিজ সংলগ্ন বধ্যভূমি। এর পাশেই ছিল বাংকার। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে এখানে ৬০ থেকে ৭০ জনের কবর রয়েছে।
শহরের দাতিয়ারা ওয়াপদা ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে নিরীহ মানুষদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এখানে বাংকার নির্মাণ করে শতশত নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হত। নাটাই গ্রামের আবরু খানের তথ্য অনুযায়ী স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বধ্যভূমি খুঁড়ে ১২ জন শহিদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
সদর উপজেলার উজানিসার ব্রিজ এলাকায় একটি অরক্ষিত বধ্যভূমি রয়েছে। উজানিসার-দরখার ব্রিজের দক্ষিণ অংশে দেড় শতাধিক বাঙালির মৃতদেহ রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত হওয়ার কারণে কারো নাম ঠিকানা পরিচয় পাওয়া সম্ভব হয়নি। ভারত সীমান্ত কাছাকাছি হওয়ায় নৌকাযোগে এদিক দিয়ে ভারত যাবার সময় তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ও রাজাকারদের হাতে আটক হয়ে হত্যার শিকার হয়েছে।
শহরের কুরুলিয়া খালের পাড় বধ্যভূমি, কুরুলিয়া খালের ব্রিজের নিচে একটি অরক্ষিত বধ্যভূমি রয়েছে। সেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ বধ্যভূমি, কলেজটিকে পাকিস্তান বাহিনী বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছে। (সাত) আশুগঞ্জ খাদ্যগুদাম বধ্যভূমি, আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামকে পাকিস্তান বাহিনী বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছে।
উপজেলার সুলতানপুর বধ্যভূমি, সুলতানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। সদর উপজেলা থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে গ্রামটির অবস্থান। ১৯৭১ সালে ঐ গ্রামে ব্যাপক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সুলতানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু বন্দি ছিল। তারা কেউ-ই স্থানীয় নয়। তাদেরকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে হত্যা করে পাশর্^বতী তিতাস নদীর বিলের মধ্যে বন্যার পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হত। পাকিস্তানীদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী-ই ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেছে।
কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়ক বধ্যভূমিসহ মহাসড়কের পাশেও বধ্যভূমির তথ্য পাওয়া গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী বিজয়নগর উপজেলায় ৪টি বধ্যভূমি রয়েছে। উপজেলার ইছাপুরা ইউনিয়নের আড়িয়ল বাজার বধ্যভূমি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এক বিবাহের বরযাত্রী উপজেলার চম্পকনগর হতে সাটিরপাড়া গ্রামে যাওয়ার পথে মিলন বাজার ব্রিজ হতে পাক সেনারা সবাইকে ধরে নিয়ে আড়িয়ল বাজারের দক্ষিণ ব্রিজের দক্ষিণ পশ্চিম পাশের ১১ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাদেরকে সেখানেই গণকবর দেয়া হয় এবং রাজাকারের সাহায্যার্থে ১/২ জনকে পাক সেনার অনুমতিক্রমে অন্যত্র দাফন করা হয়। উপজেলার বুধন্তী ইউনিয়নের বীরপাশা বধ্যভূমি, বীরপাশা গ্রামের হাজী জজ মিয়ার বাড়ির পূর্বপাশে বিদ্যুৎ খুঁটি সংলগ্ন স্থানটি বধ্যভূমি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তখন এ গ্রামের পাকিস্তান বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় প্রায় বাড়িতে আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দেয়। গ্রামের ১০ জন নিরীহ জনগণকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে ধরে নিয়ে হাজী জজ মিয়ার বাড়ির পূর্বপাশে বিদ্যুৎ সংলগ্ন স্থানে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং তাদেরকে সেখানেই গণকবর দেয়া হয়। উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শ্যামার বাড়ির দক্ষিণে ১০০ গজ দূরে বধ্যভূমি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চানপুর গ্রামের ৪জন ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু শ্যামার বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ গজ দূরে জঙ্গলের মধ্যে এবং ২ দজনকে বাড়িতে মোট ৬ জনকে হত্যা করে জঙ্গলের মধ্যে রেখে দেয়া হয়। ৯ মাস পর জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে ৬ জনের মাথাসহ হাড় পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে ২ জনকে চানপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠে ও রেলের পশ্চিম পাশের কবরস্থানে, ২ জনকে শাহেদ মিয়া ও মুসা মিয়ার বাড়ির বাঁশ ঝাড় কবরস্থানে, ১ জনকে খাটিঙ্গা গ্রামের কাশেম আলীর বাড়ির কবরস্থানে এবং ১ জনকে পাহাড়পুর গ্রামের আ. জব্বারের বাড়ির কবরস্থানে সমাহিত করার তথ্য পাওয়া গেছে। একই ইউনিয়নের আউলিয়া বাজারের দক্ষিণে মসজিদের পশ্চিম পাশের্^ বধ্যভূমি। সে সময় ৩ জন লোক মুক্তিযোদ্ধাকে সাহায্য করত: পাকিস্তান বাহিনী তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে ধরে নিয়ে হত্য করে এবং তাদেরকে সেখানেই গণকবর দেয়া হয়।