বেড়ায় ভূমি ও গৃহহীনদের অধরা স্বপ্ন জয়ে উঁকি দিচ্ছে আশার আলো
উপজেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১:০৪ অপরাহ্ন, ১০ই এপ্রিল ২০২৩
পাবনার বেড়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ রাস্তাগুলো এখন পিচঢালা। রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর একটু পরপর সবুজ ছাঁয়াঢাকা গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলো বেশিরভাগই টিনের। ইটের আধাপাকা দু-চারটি ঘর চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে।
উপজেলার মাসুমদিয়া ইউনিয়নের এমনি এক গ্রাম ফকিরকান্দি। এ গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে একসঙ্গে অনেকগুলো লাল-নীল-সবুজ রঙের আধাপাকা ঘর। ওই ইউনিয়নের কেজিবি কলেজের পুকুর পাড়ে আরও ১৯টি ঘর তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৭টি পরিবারের জন্য ঘর তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে ১৯টির ফিনিশিং কাজ চলছে জোরতোর ভাবে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তৈরি হয়েছে, হচ্ছে এসব ঘর। এখানে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের অনেকেই থাকতেন অন্যের জায়গায় ঘর তুলে। কেউ ছিলেন খাসজমিতে, কেউবা মুজিব বাঁধের ঢালুতে ঝুপড়ি ঘরে। এ আশ্রয়ণ প্রকল্প তাদের দিচ্ছে আপন ঠিকানা। নিজের জায়গায় নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তাই তাদের মনে নতুন স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সেসব কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন আশ্রয়ণের বাসিন্দারা। ফকিরকান্দি আশ্রয়ণের শিরিন খাতুনের সামনের ঘরটাই ছাত্তার মোল্লার। ৫৫ বছর বয়সে এসে নিজের এক টুকরো জায়গা পেলেন তিনি। ঘর পেতে এক টাকাও খরচ হয়নি। স্ত্রী জোমেলাকে নিয়ে থাকেন নিজের বাড়িতে।
কথার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বললেন, ‘উনিই এখন আমার নিকটের’। সালেহা, ইলিয়াস, লাকিসহ আরও বেশ কয়েকজনের জীবনের গল্প মোটামুটি একইরকম। অন্যের জায়গায় কোনোরকমে মাথা গুঁজে বেঁচে ছিলেন তারা। ছিলনা স্বাধীনতা আত্মমর্যদা। অসহায় এ মানুষগুলোর এখন নিজের স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে।
আত্মপরিচয়ে মাথা উঁচু করে নতুন জীবনে যাত্রা শুরু হয়েছে তাদের। ৪০ বছর বয়সী মর্জিনা খাতুন স্বামী গফুর প্রামানিক পেশায় তাঁত শ্রমিক। তারা এখন হাটুরিয়ার আশ্রয়ণের বাড়ির মালিক। এক সময় বসবাস করতেন হিন্দু বাড়িতে। অবহেলা আর নানা বঞ্চনায় দিন কেটেছে। এখন তাদের দিন বদলেছে, জীবনও পালটেছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিজের বাড়িতে বসবাস করছেন।
শুধু তাই নয়, ঘরের বারান্দায় তাঁত পেতে পালাক্রমে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে কাপড় তৈরি করছেন। তিনি বলেন, এখন অনেক ভালো আছি। কারণ একজন মানুষের ঠিকানা যে কত বড় বিষয় সেটা আমরাই কেবল বুঝি। জব্বার মিয়া ৪০ বছর মাছ ধরে জীবন কাটাচ্ছেন। মাছ পেলে চুলা জ্বলে, না পেলে অনাহারে থাকতে হয়।
স্ত্রী সকিনা বেগমকে নিয়ে যমুনা নদী পাড়ে ছোট ঝুপড়িতে থাকতেন। জীবনের শেষ বেলায় এসে নিজের জায়গা হলো তার। স্ত্রীকে পাশে নিয়ে নতুন জীবনের গল্প শুরুর আগে অতীতের কথা বললেন তিনি,‘ সারা জীবন নদ-নদীতে মাছ শিকার করে কষ্টে সংসার চালিয়েছি। নিজের ঘর হবে, তা কখনো ভাবিনি। তাও আবার পাকাঘর।
এটা তো স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি’। এখন আমার জীবনে পরিবর্তন এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে জমিসহ ঘর উপহার দিয়েছে। যে জমি পেয়েছেন সে জমির সামনে এবং পেছনের অংশে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ শুরু করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, শসা, বরবটি, পুঁইশাক. ইত্যাদি।
মাসুমদিয়া আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা কমলা বিবি জানান, এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুটি ঘর বিশিষ্ট একটি বাড়িতে আছি। এটাই এখন আমার নিজের ঠিকানা। আমার নিজের আশ্রয়। এখানে ইচ্ছামতো বসবাস করতে পারি। স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারছি। নিজের ঠিকানা যার আছে, সে বুঝবে না। আমাদের সেই দুর্দিন দূর হয়েছে।
এখন আমরা সুখে আছি। একই অনুভূতি জানালেন ২৫ বছর বয়সী আর্জিনা বেগম। তার স্বামী সেলিম একজন দিনমজুর। আশ্রয়কেন্দ্রের বাড়িটি এখন তাদের। এটাই তাদের স্থায়ী ঠিকানা। আগে আমাদের কোন বাড়ি-ঘর ছিল না। অন্যের বাড়ির বারান্দায় থাকতাম। সে বারান্দাতেই দুই সন্তান ও স্বামী-স্ত্রী অনেক কষ্ট করে জীবন কাটিয়েছি।
সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি দেয়া হয়েছে। এটা যে কত আনন্দের, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবো না। আজ আমি নিজের সংসার নিয়ে নিজের বাড়িতে বসবাস করতে পারছি। রবিউল ইসলাম ক্লাস সেভেনে পড়েন। স্বপ্ন দেখেন একদিন অনেক বড় হবে। বাবা আফজাল হোসেন আর মা জেসমিন বেগমের সাথে আশ্রয়ণের একটি ঘরে থাকে সে।
জীবনের পরিবর্তনটা এখানে কেমন, প্রশ্ন করতেই রবিউলের উত্তর বিদ্যুৎ আছে, মাথার ওপর ছাদ আছে, এখানকার পরিবেশও খুব ভাল। আগের থেকে পড়াশোনা অনেক ভালো হচ্ছে। অনেক বড় হতে চাই।
৯৫ বছরের পারুল বেগম এবং রবিউল ইসলাম দুই প্রজন্মের এই দুইজনের সুখে-শান্তিতে থাকা কিংবা স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। পারুল বেগম এবং রবিউল ইসলামের মতো এমন লাখো গৃহহীন ও ভূমিহীন অসহায় মানুষকে একটি ঠিকানা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ন প্রকল্প। উপকারভোগী আরেকজন মোছাঃ খাদিজা খাতুন।
এক ছেলে, দুই মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে বসবাস। ভূমিহীন তসলিমার এখন একটাই স্বপ্ন ছেলে মেয়েদের মানুষ করা। স্বামী রিক্সাভ্যান চালিয়ে ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা ভাল আছি।
ছেলে মেয়েদের সুবিধা হয়েছে। তারা এখন বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করে। ইসমাইল হোসেনের ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলেকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। নিজে কষ্ট করেন, তাঁত শ্রমিকের কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে এখন মাথা থেকে চিন্তা চলে গেছে তার। অন্তত মাথার ওপর ছাদটুকু তো আছে।
সেই কথা বলতে গিয়ে ইসমাইল স্মৃতিচারণ করেন পুরোনো দিনের, চরনাকালিয়া গ্রামে আমরা থাকতাম। নদী ভাঙনে সব গেছে। অনেক দিন এখানে সেখানে থাকছি। ভাঙা টিন আর এটা ওটা দিয়ে ছাপরা করে থাকতাম। নতুন ভারেঙ্গ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু দাউদ বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের জমি ক্রয় ও বাড়ি বরাদ্দে অনিয়মের কোন সুযোগ নেই। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সবুর আলী, সহকারী কমিশনার ভূমি, প্রতিটি ইউনিয়নের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যাচাই-বছাই করে প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া কাজের গুনগতমান ঠিক রেখে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, হয়েছে। জানা যায়, উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৩৬১টি ঘরের নির্মাণ কাজ চলছে। ক্রয়কৃত ও খাসজমিতে আশ্রয়ণের ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, হচ্ছে। সরকারি বিধিমতে এ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি কাজ করছেন।
তারা হলেন, এ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, সদস্য উপজেলা সহকারি কমিশনার ভূমি, উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান।
বেড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ আরিফুল ইসলাম জানান,, উপজেলায় ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে আশ্রয়নের মোট ৮৭৪টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায়ে ২৪০ টি, ৪র্থ পর্যায়ের ২৭১টি ও উপজেলা পরিষদ প্রদত্ত ২টি ঘরসহ মোট ৫১৩টি ঘরে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলো বসবাস করছেন।
৩৬১টি ঘরের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। আশ্রয়ণেন ঘর নির্মাণে প্রয়োজন হয়েছে এক হাজার ৮৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ ভূমি। এরমধ্যে খাস এক হাজার ১০০ শতাংশ ও ক্রয়কৃত ভূমি রয়েছে ৭৫১ দশমিক ৩১ শতাংশ। বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সবুর আলী বলেন, জীবনে যত মানবিক কাজ করেছি এটা হলো তার মধ্যে অন্যতম। এই কাজ করার অনুভূতি আসলে একেবারেই ব্যতিক্রম।
ছিন্নমূল ভূমিহীন মানুষদের একটি ঘর দিতে পেরে ভাল লাগছে। তাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করছি, তা সত্যি অভাবনীয়। এখানকার মানুষের অনুভূতি, তাদের আনন্দ আমাদের পুলকিত করে। তিনি বলেন, তারা সবচেয়ে বেশি খুশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। কারণ তিনি তাদের ঘরটি দিয়েছেন বলেই আজ তারা ঠিকানা পেয়েছেন। জীবনকে বদলে দিতে পেরেছেন।
এক সময় রোদেপোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা মানুষগুলো আজ আত্মমর্যাদা নিয়ে নিজেদের ঘরে বসবাস করতে পারছেন। প্রধানমন্ত্রীর কারণে এ ধরনের কাজ করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি। বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া- নাকালিয়া, মাসুমদিয়া, চাকলসহ ৯টিা ইউনিয়ন সরেজমিন ঘুরে উপকারভোগীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখন তারা কেউ বসে নেই।
সবাই কিছু না কিছু করছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার দারুন প্রচেষ্টা আছে আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের। কেউ কেউ গরু মোটাতাজা করছেন, কেউ ছাগল পালন করছেন, আবার কেউবা তাঁত পেতে কাপড় তৈরি করছেন, কেউ দোকান দিয়েছেন। এই একটি ঘরই তাদের জীবনই বদলে দিয়েছে। সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। এক সময়ে অবহেলিত, নিঃস্ব মানুষগুলো এখন সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন।
আরএক্স/