মৃতপ্রায় খাপড়াভাঙ্গা নদী


Janobani

উপজেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫:১৯ পূর্বাহ্ন, ৫ই মে ২০২৩


মৃতপ্রায় খাপড়াভাঙ্গা নদী
ছবি: জনবাণী

এক সময় জোয়ার ভাটার কলকল স্রোতে বয়ে যাওয়া নদীটি এখন খালে পরিনত হয়েছে। এপাড় থেকে ওপাড় সাঁতার কাটতে ভয় হত। এখন যে কেউ, এক ডুবে যেতে পারে ওপাড়ে। এক পাড় থেকে ঢিল ছুঁড়ে ওপর পাড়ে নিতে পারে কিশোররাও। 


পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী-মহিপুর এবং ধুলাসার-ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খাপড়াভাঙ্গা নদী এটি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে দিনে দিনে মরে যাচ্ছে নদীটি। নদীটি নিয়ে নেই কারো কোন মাথা ব্যাথা। আর এ সুযোগে দু’পাশের দখলদাররা গলাটিপে হত্যা করছে নদীটি। ফলে এ অঞ্চলের মৎস্যজীবী জেলে, মাছ ব্যবসায়ীসহ অন্যান্য সকল ব্যবসায়ীদের ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ব্যাপক আংশকা রয়েছে। 


কুয়াকাটা থেকে সুন্দরবনে পর্যটক পরিবহনের জন্য গ্রীণ লাইন-৭ লঞ্চের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহাজাহান খান নদীটি খনন করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে কবে নাগাদ তা আলোর মুখ দেখবে তিনি তা নিশ্চিত করেননি। এরপর আর কেউ নেয়নি খনন করার উদ্যোগ। কেউ শুনছে না নদীটির বাঁচার আকুতি। ফলে দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে দু’মাথা সমুদ্রে মিলিত দোনটি।   


নদী বাঁচাও আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, নদীর জলপ্রবাহের সাথে আমাদের জীবন জীবিকা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নদীর পানিপ্রবাহ থেকে গেলে আমাদের জীবনও থেমে যাবে। সভ্যতার মূল শিকড় হলো নদী। নদী তীরেই যুগ যুগ ধরে মানব সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতায় সেটা থমকে গেছে। একে চলমান করার জন্যই কাজ করছে ‘নদী বাঁচাও আন্দোলন’। 


উপকূলের মৎস্যজীবী জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে ফিরে আসে নদীটিতে। দূর্যোগকালীন সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল এ দোনটি। সমুদ্র ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে কয়েক হাজার মাছ ধরার ট্রলার এ নদীতে এসে নিরাপদে নোঙ্গর করে। তাই খাপড়াভাঙ্গা নদীটি উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দূর দূরান্তের জেলেদের কাছে পোতাশ্রয় নামে পরিচিত। নদীটির দু’পাড় থেকে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার মাছ দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এজন্যই আলীপুর-মহিপুর মৎস্য বন্দর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। 


এ নদীটি পুরোপুরি মরে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশের বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবী জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে জেলেরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে না। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা পড়বে বিপাকে। মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটার অন্যান্য ব্যবসায়ীরা পারবে না নৌপথে খুলনা, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল থেকে মালামাল আনতে। এখন শেষ ভাটায় মালবাহী ট্রলার, ষ্টিমার ও মাছ ধরার বড় ট্রলার নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সমুদ্র মোহনায়। 


ট্রলার মাঝি ইউনুচ মিয়া বলেন, আমরা গভীর সমুদ্রে ফিশিং করি। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে দ্রুত এ নদীতে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারি। কিন্তু বর্তমানে ভাটার সময় প্রবেশ করতে পারছি না। জোয়ারের অপেক্ষায় ঝুকি নিয়ে সমুদ্র মোহনায় থাকতে হয়।  


আরেক মাঝি একলাচ গাজী জানান, হাজার হাজার গভীর সমুদ্রগামী ট্রলারের নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত খনন করতে হবে। অন্যথায় চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে নদীতে কোন ট্রলার প্রবেশ করতে পারবে না। গত বর্ষা মৌসুমে গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে মোহনায় একটি ট্রলার নিমজ্জিত হয়েছিলো।


কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি মন্নান মাঝি জানান, তারা সাগরে থাকা অবস্থায় বন্যার সংকেত পেয়ে নদীটিতে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। এটি মরে গেলে শত শত ট্রলার কোথায় আশ্রয় নিবে এমন প্রশ্ন তারও। বর্তমানে ভরাট হয়ে ছোট হওয়ার কারণে মোহনা থেকে প্রবেশ করার সময় ট্রলার নিমজ্জিত হওয়ার ভয় থাকে। 


বারেক মাঝি বলেন, খাল ভরাট হওয়ায় চাপলী বাজারের ব্রীজ দিয়ে চলাচলে ট্রলার নোঙ্গর করে বসে থাকতে হয় ঘন্টার পড়ে ঘন্টা সময় মত সাগরে পৌঁছাতে না পেড়ে অর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় আমাদের। 


দিন দিন যৌবন হারিয়ে নদীটি এখন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। কেন পোতাশ্রয় খ্যাত নদীটি মরে যাচ্ছে তার কারণ কেউ শনাক্ত করছে না। এমনকি খনন করা উদ্যোগও নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শুধু নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্থাপনা উচ্ছেদ করেই দায় শেষ। ফলে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এরপরেও অদৃশ্য শক্তির জোরে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা। 


এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের কুয়াকাটা শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘নদীর জমির ভরাট করে দু’পাড়ে অবৈধ দখলদাররা আধাপাকা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। শেখ রাসেল সেতুর স্প্যানে স্রোতে বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে নাব্যতা ধীরে ধীরে কমছে। মৎস্য বন্দরের সবধরণের অপচনশীর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুন্দর না হওয়ার কারণে দখল-দূষণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীটি। 


সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে প্রচন্ড ঢেউয়ের ঝাপটায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকার বালু ক্ষয়ে নদীর প্রবেশ মুখে চর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে খাপড়াভাঙ্গা নদীতে জোয়ার-ভাটার স্রোত কমে যাচ্ছে। স্রোত কমে যাওয়ার জন্যই নদীটির তলদেশ আস্তে আস্তে ভরাট হচ্ছে বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করছেন নদীটির দু’তীরে ট্রলার মালিকদের নোঙ্গর করে রাখা অকোঁজো পুরানো ট্রলারের বডি, বর্ষা মৌসুমে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোর্ড ব্যবসায়ীদের রাখা ট্রলার, মৎস্য আড়ৎদার ব্যবসায়ীদের গদিতে মাছ ওঠানোর জেডি, বরফকল মালিকদের বরফ নামানোর জেডি, এসকল জেডির পাড়ে নদীর তীরের নির্মিত রাস্তা, নদীর পাড়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের রাখা বাঁশ, নদীতে নির্মানাধীন শেখ রাসেল সেতুর স্প্যান ও অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার জন্য স্রোত বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে পলি জমে নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের ব্যবহৃত অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। যার ফলে পূর্ণ যৌবন হারিয়ে ফেলছে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি।


এদিকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক প্রভাবশালীরা নদীর তীরের মাটি কেটে বাঁধ দিয়ে ব্যক্তিমালিকানা জমির পরিধি বৃদ্ধি করছেন তাদের দেখাদেখি স্থানীয় বাসিন্দারাও মাটি কেটে বাঁধ দিয়ে নদীর তীর দখল করছেন।


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র কলাপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ বছর পর্যন্ত খাপড়াভাঙ্গা ও আন্ধারমানিক নদীসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের কবল থেকে রক্ষার দাবিতে সামাজিক আন্দোলন করছি। নদী রক্ষা কমিটির সভায় একাধিকবার বলা হয়েছে, অবৈধ দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করে, এদের উচ্ছেদ করে নদী দখল মুক্ত করা হউক। নদীর সাথে জলকপাট, খালও আমরা দখল মুক্ত দাবী করে আসছি। কিন্তু এর কোন অগ্রগতি আমার দেখতে পারছি না। এর জন্য আমরা হতাশা এবং বিস্ময় প্রকাশ করছি। 


নদীটির বাঁচার আকুতি শুনে কথা হয়েছিল বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন’র সাথে। তিনি বলেন, নদীটি মরে গেলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির উপর। তিনি আরও বলেন, খাপড়াভাঙ্গা নদীর দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ খনন করা খুবই জরুরী। ফলে নদীতে স্রোত বৃদ্ধি পেয়ে হারানো যৌবন ফিরে পাবে খাপড়াভাঙ্গা নদী।  


কিন্তু নদীটি কবে নাগাদ খনন করা হবে, এর কোন সঠিক জবাব দিতে পারেনি পাউবো কর্তৃপক্ষ। কলাপাড়া উপজেলা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, সারা বাংলাদেশে খাল খনন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেই প্রকল্পে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি খননের জন্য প্রস্তাবনা দেয়া আছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরেজমিনে তালিকা প্রস্তুত করে উচ্ছেদ করা হবে।