অপহৃতদের হত্যার পর মরদেহ আগুনে পুঁড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা


Janobani

জেলা প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৬:০৫ অপরাহ্ন, ২৫শে মে ২০২৩


অপহৃতদের হত্যার পর মরদেহ আগুনে পুঁড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা
আটককৃত ২ আসামি

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়াস্থ গহীন পাহাড়। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পশ্চিমে অনুমানিক আড়াই কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ে ঢালুতে বিচ্ছিন্নভাবে পড়া ছিল ৩ টি মরদেহ। শরীর থেকে মাংস গলিত হয়ে অনেকটা কংকাল, আবার বিচ্ছিন্ন ছিল মাথাও।


বুধবার (২৪ মে) সন্ধ্যায় র‌্যাব-পুলিশে যৌথ অভিযানে মরদেহের সন্ধান পাওয়ার পর খবর পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের। তাদের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় মরদেহ ৩ টি।


এ ঘটনায় পুলিশ ও র‌্যাবের পৃথক অভিযানে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন, টেকনাফের মোচনী ক্যাম্পের আবু সামাদের ছেলে সৈয়দ হোসেন প্রকাশ সোনালী ডাকাত, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদারবিলের মৃত আব্দুল করিমের ছেলে এমরুল করিম প্রকাশ ফইরা, মোচনী ক্যাম্পের আবু তাহেরের ছেলে শফি আলম বেলাল, শফির ভাগিনা এবং একই ক্যাম্পের আবদুল মতলবের ছেলে আরাফাত।


র‌্যাবের দাবি গ্রেপ্তার সোনালী ডাকাত অপহরণ ও হত্যার অন্যতম হোতা। আর অপহৃত ৩ জনকে হত্যার পর আগুনে পুঁড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাও করেছে অপহরণকারিরা।


বৃহস্পতিবার দুপুরে এ বিষয়ে র‌্যাব ১৫ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক সাইফুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, পাত্রী দেখতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন কক্সবাজার চৌফলদন্ডী উত্তরপাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে জমির হোসেন রুবেল, তার দুই বন্ধু ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগর পাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউছুপ ও কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার ইমরান। ২৮ এপ্রিল অপহরণের পরের দিন ২৯ এপ্রিল রুবেলের মোবাইল থেকে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ৩০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে। পরিবারকে ভয় দেখাতে নিযার্তনের একটি ভিডিও তাদের কাছে প্রেরণ করে। ঘটনাটি জানার পর থেকে র‌্যাব অপহৃতদের উদ্ধার ও অপহরণকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায়।


র‌্যাব অধিনায়ক জানান, নির্যাতনের ফুটেজে অপহরণকারী চক্রের একজনকে শনাক্ত করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করে ২৪ মে টেকনাফ হাবিরছড়া দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় অভিযান চালিয়ে অপহরণ চক্রের মূলহোতা সোনালী ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সোনালী র‌্যাবকে জানায়, অপহৃতদের গুলি করে হত্যা করার পর পাহাড়ে উপর থেকে ফেলে দেয়া হয়। পরে মরদেহগুলো আগুনে পুড়ে আলামত ধ্বংস করারও চেষ্টা করা হয়। গলিত মরদেহগুলো অপহৃত রুবেল, ইমরান এবং ইউসুফের বলে জানিয়েছেন সোনালী ডাকাত।


টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, গত ২৮ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়া ৩ যুবক নিখোঁজ হয়। এব্যাপারে কক্সবাজার সদর থানায় সাধারণ ডায়েরী লিপিবদ্ধ করা হয়। ৩ যুবকের স্বজনরা জানিয়েছিল এদের অপহরণ করা হয়েছে এবং ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে। এর সূত্র ধরে গত ১৩ মে টেকনাফ থানার পুলিশ টেকনাফের মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শফি আলম বেলাল (২৮) নামের এক রোহিঙ্গাকে আটক করে। তার দেয়ার তথ্য মতে র‌্যাবের সহযোগিতায় আটক করা হয় একই ক্যাম্পের আরাফাত (২২) নামের অপর এক রোহিঙ্গাকে। আরাফাতের কাছে মিলে অপহৃত রুবেলের মোবাইল ফোনও।


ওসি জানান, আটক ২ জন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার জালালাবাদ সওদাগর পাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউছুপ, চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের রুবেল, কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার ইমরান গত ২৮ এপ্রিল তাদের কাছে আসেন। শফি আলম কহিনূর নামের এক মেয়েকে দেখার টোপ দিয়ে রুবেলকে আনা হয়। রুবেলের সাথে অপর ২ জন আসেন। তাদের হত্যার পর পাহাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এব্যাপারে গত ১৩ মে টেকনাফ থানায় মামলাও করেছে রুবেলের পিতা।


র‌্যাব ১৫ এর অধিনায়ক লে. কর্ণেল সাইফুল ইসলাম সুমন জানিয়েছেন, মরদেহ ৩ টি টেকনাফ গিয়ে গত ২৮ এপ্রিল অপহৃত ৩ যুবকের বলে আটক ও অপহৃতদের স্বজনরা দাবি করছেন। তবে মরদেহ শনাক্ত করার কোন সুযোগ নেই। এপরিস্থিতিতে ডিএনএ পরীক্ষার পর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিষয়টি পুলিশ সুরেতহাল প্রতিবেদন তৈরির পর আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।


তিনি জানান, পাহাড়ে অপহরণ সহ সকল অপরাধ রোধে র‌্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এ ঘটনায় আর কারা জড়িত তাদের নামও পাওয়া গেছে। তাদের আটক অভিযান চলছে।


অপহারণকারীদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফের দুটি ইউনিয়নের পাহাড়। টেকনাফের বাহারছড়া ও হোয়াইক্যং এ পাহাড় ঘীরে ৭ মাসে অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় ৭ টি মামলা হয়েছে।


টেকনাফ থানা পুলিশের তথ্য বলছে, এসব মামলায় ৪৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৩ জন। এসব ঘটনায় ২৩ জনকে অপহরণে তথ্য আসলেও প্রকৃত তথ্য ভিন্ন।


এলাকাবাসির তথ্য বলছে গত ৮ মাসে টেকনাফের পাহাড় কেন্দ্রিক ৬৫ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ অপহৃত ৫ রোহিঙ্গা শিশু ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ৪ দিন পর শনিবার মুক্তি পেয়েছেন। সর্বশেষ সোমবার ২ জন সহ ২০ জন মুক্তিপণ ছাড়া ফিরলেও অন্যান্যরা মুক্তিপণে ফিরেছেন।


সর্বশেষ টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা থেকে অপহৃত আলী হোসেনের (৫৫) সন্ধান না মিলেনি গত ৫ দিনেও। ২১ মে রবিবার সকালে লেদার পাহাড়ি এলাকায় গরু চড়াতে গেলে কৃষক আলী হোসেনকে অপহরণ করে টেকনাফের গহিন পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। আলী হোসেনের বাড়ি লেদার মৌলভীপাড়ায়।


অপহৃত আলীর ছোট ভাই কামাল হোসেন জানিয়েছেন, তাঁর বড় ভাই লেদার পুরোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্প পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি এলাকায় গরু চড়াতে যান। সেখানে তাঁর কৃষিজমি রয়েছে। ২১ মে বেলা তিনটার দিকে মুঠোফোনে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি মুক্তিপণের ১০ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেন। এরপর অপহৃত আলীর সঙ্গে কথা বলতে দেন। ওই সময় আলী তাঁকে বলেন, তিনি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহৃত হয়েছেন। অপহরণের খবর পুলিশ, র‌্যাবসহ কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে। এ কারণে অপহরণের খবর তাঁরা পুলিশকে জানাননি।


টেকনাফ থানার ওসি মো. আবদুল হালিম বলেন, হ্নীলা থেকে কৃষক অপহরণের ঘটনা তাঁর জানা নেই। এ বিষয়ে কেউ থানায় অভিযোগও করেননি। তারপরও তিনি ঘটনার অনুসন্ধান করছেন।


এ সব অপহরণের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রæপ সালমান, সালে, আবু আলা ও নবী হোসেন গ্রæপের সদস্যরা জড়িত বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। পাহাড়ের আশে-পাশে এলাকার সাধারণ মানুষ হিসেবে পরিচিত স্থানীয় লোকজন তাদের সহযোগি হিসেবে কাজ করছেন। পুলিশের অভিযান তথ্য পাহাড়ে অবস্থান নেয়া সন্ত্রাসীদের আগাম বলে দেয়া, মুক্তিপনের টাকা আদায়ে সহযোগিতা করা ছাড়াও সন্ত্রাসীদের পাহাড়ে খাবার সরবরাহ করে এই সহযোগিতার কাজটি করছেন।


এর মধ্যে টেকনাফের দুর্গম পাহাড় কেন্দ্রিক রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রæপ ছালে বাহিনীর সাথে গোলাগুলির পর অস্ত্র ও গুলি সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তারের মধ্যে রয়েছে ছালেহ বাহিনীর প্রধান হাফিজুর রহমান প্রকাশ ছালে উদ্দীন, তার সহযোগি সোহেল ডাকাতও।



আরএক্স/