ভাষার মর্যাদা রক্ষায়, বিচার বিভাগে বাংলার প্রচলন বৃদ্ধি করতে হবে


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


ভাষার মর্যাদা রক্ষায়, বিচার বিভাগে বাংলার প্রচলন বৃদ্ধি করতে হবে

ভাবের বাহন হলো ভাষা। ভাষা যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমেই একের ভাব অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা সম্ভব হয়। বাংলা হলো বাঙালির মাতৃভাষা। এ ভাষার রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় চব্বিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে।

মানুষের মনের ভাব, আনন্দ-বেদনা, ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা সবকিছু স্বদেশী ভাষা তথা মাতৃভাষাতেই যথার্থভাবে প্রকাশিত হয়। একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নে সর্বস্তরে সে জাতির মাতৃভাষার প্রচলন অপরিহার্য।

পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত ও সম্মানিত হলেও অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় খােদ বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীর কাছে বাংলা ভাষা যেন অবহেলিত। অযত্ন অনাদরে পড়ে আছে দুঃখিনী বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে যে স্বপ্ন নিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা, তাঁদের সে। স্বপ্ন যেন আজ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ব্যাক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই উপেক্ষিত বাংলা।

১৯৫২ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে ভাষাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। আর ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী দিবস ২১ ফেব্রুয়ারিই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের। কিন্তু এ দেশের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনও উপেক্ষিত।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমি ঘােষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পায় বাংলা। সংবিধানের ৩য় অনুচ্ছেদে লেখা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিলেও সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। ফলে ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ৩ (১) বলা হয়েছে এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যােগাযােগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিত হবে। এই ধারা মােতাবেক কোন কর্মস্থলে যদি কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তাহলে  সেটা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।এই আইনটি ব্যর্থ হলে ১৯৯৮ সালের শেষদিকে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কার্যক্রম গঠন করা হয়। এর কর্মপরিধির মধ্যে অন্যতম ছিল বৃটিশ আমল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও আদালতের প্রযােজ্য ইংরেজিতে প্রণীত আইন।এ কার্যক্রমটি কিছুদিন জোরেশারে চললেও এক সময় তা গতি হারিয়ে ফেলে। আজ এর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।

সুপ্রিম কোর্টের রুলসেও আদালতের ভাষা হিসেবে প্রথমে বাংলা এবং পরে অন্য ভাষা ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে; কিন্তু এর পরও উচ্চ আদালতের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে কার্যকর উদ্যোগ নেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের। কয়েকজন বিচারপতি ব্যক্তিগত আগ্রহে বাংলায় কয়েকটি রায় দিলেও এর সংখ্যা হাতেগোনা। অথচ সদিচ্ছা থাকলে যে-কোনো সময় উচ্চ আদালতের সর্বস্তরে এর ব্যবহার শুরু করা সম্ভব।

অন্যদিকে সংবিধানের প্রথম ভাগের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা৷বাংলাদেশের সংবিধান বাংলায় লেখা৷ এর একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি ভাষ্য আছে৷ তবে সংবিধানের কোন বিষয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিলে বাংলাই প্রাধান্য পাবে।সংবিধানের ১৫৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের  ক্ষেত্রে বাংলাটা প্রাধান্য পাবে। অর্থাৎ বাংলাকে সর্বোচ্চ মযার্দা দেয়া হয়েছে। 

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার’ অধিকার দেওয়া হয়েছে। তাহলে  উচ্চ আদালতে কেন বিচার প্রার্থীরা বাংলায় বিচার চাইতে পারবে না?তাহলে কি এটা সংবিধান পরিপন্থী হবে না?বস্তুত বাংলাভাষার এ দীনদশার মূল কারণ আমাদের কোনো ভাষানীতি নেই, নেই কোনো ভাষা পরিকল্পনা। বিকৃতিকারীদের জন্য নেই কঠোর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা। অথচ একুশের চেতনার কথা হরহামেশা আমরা বলে থাকি,ভাষা নিয়ে কত শত গর্ব করি। কিন্তু অন্তরে ও বাইরে গভীর অনুরাগ লালন করি না। 

হাইকোর্ট বিভাগে কোন কোন বিচারক ভাষার মাসকে বিবেচনায় রেখে ২/১টি রায় বাংলা ভাষায় দিলেও আদালতে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার প্রচলন নেই। রায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পুণ আইনি শব্দ বিদেশি হওয়ার কারণে ইংরেজিতে রায় দেয়া হয়। যে শব্দগুলোর বাংলায় রুপান্তর করা যায় তা কেন এখন পর্যন্ত বাংলায় বলা হচ্ছে না। আইনগুলো ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলায় রুপান্তর করার কাজ শুরু করলে বিচার অঙ্গনে বাংলা প্রচলন সহজ হবে।

একুশের যে স্লোগান ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা,’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্ব স্তরে বাংলাভাষা চালুক কর’, ‘মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন’ তার প্রতি আকৃষ্ট হই না। কিন্তু চীন, কোরিয়া, জার্মানি, জাপান, তুরস্ক, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইরানি প্রমুখ জাতি মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাইলে আমাদের আগে মাতৃভাষার দ্বারস্থ হতে হবে। তাই ভাষার গাঁথুনি সবল করার পাশাপাশি বাংলাভাষাকে অর্থনৈতিক স্রোতধারার সঙ্গে সংযোগ সাধন করতে হবে। এরপরে ভাষার প্রতি নজর দিতে হবে। কারণ শেকড় শক্ত-পোক্ত না হলে সে বৃক্ষ কোনদিন ফলবতী হয় না, তেমনি শত-সহস্র শাখায় সেটি পল্লবিতও হয় না।

বিচার বিভাগে বাংলা ভাষা  চালু শুধু আবেগের বিষয় নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গেও এটি সম্পৃক্ত। গণতান্ত্রিক রীতিপদ্ধতি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে অফিস-আদালত ও জনতার ভাষার মধ্যে সাদৃশ্য থাকা জরুরি। বিচার প্রার্থী সাধারণ মানুষ আদালতের ভাষা বুঝতে না পেরে অতিরিক্ত খরচ ও হয়রানির স্বীকার হয়, যা ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক একই রকমভাবে, বিদেশি ভাষায় বর্ণিত জ্ঞান কিংবা রচিত গ্রন্থ যতই মূল্যবান ও তথ্য সম্বলিত হােক না কেন তা নিতান্তই অর্থহীন, যদি তা মাতৃভাষায় অনূদিত হয়ে শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে না পৌছায়। অর্থাৎ উপলব্ধির জন্য শেষ পর্যন্ত মাতৃভাষার। শুদ্ধ স্বদেশি সাংস্কৃতিক চর্চা ও উন্নয়ন, একটি আত্মনির্ভরশীল ভাষাগােষ্ঠী হিসেবে বিশ্বের বুকে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার অতিব জরুরি। সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মের। জন্য স্বল্প ব্যবহৃত জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষা নয়, একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত ভাষা রেখে যেতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতে হবে এখনই।

এসএ/