দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনপ্রতিনিধি চাই
জনবাণী ডেস্ক
প্রকাশ: ০৬:৩৬ অপরাহ্ন, ১৭ই জুন ২০২৩
স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছে বাংলাদেশ। দেশ নানাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন সন্নিকটে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের হাত ধরেই গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়। এখন লক্ষ করা যায় দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে অনীহা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। তারা রাজনীতির প্রতি বিমুখ হয়ে পড়ছে। তাদের এই রাজনীতিবিমুখতার পেছনে কাজ করছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয় এবং সহিংস রূপ। বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চায় যেমন সমস্যা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। রাজনীতিতে বহুসংখ্যক শিক্ষিত নেতা প্রয়োজন, প্রয়োজন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা। এদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে অসীম একাগ্রতা, যার প্রমাণ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের গণতন্ত্র যদি দুর্বল হয়, তবে তা বাঙালি জাতির জন্য চরম লজ্জার। গণতন্ত্র রক্ষা করতে পারলে এদেশে আসবে কাক্সিক্ষত শান্তি ও স্থিতিশীলতা। জনগণ পাবে পূর্ণ স্বাধীনতা ও মুক্ত গণতন্ত্রের স্বাদ।
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নবীন প্রজন্মের প্রত্যাশা অনেক। আমরা চাই, ডিজিটাল বাংলাদেশে সুস্থ ধারার পরিচ্ছন্ন গণতান্ত্রিক চর্চার পথ বিকশিত হোক। এছাড়াও আমরা চাই- অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বন্ধ করা, জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করা, নির্বাচন কমিশনকে বিশ্বাসযোগ্য, নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী করা, তথ্য অধিকার আইনের সংস্কার ইত্যাদি। স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে আসলেই রাজনৈতিক মহলে দেখা দেয় তীব্র উত্তেজনা ও পক্ষ-প্রতিপক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ এখন ব্যক্তির ও দলের মূল চালিকাশক্তি। হীন স্বার্থান্বেষীরা যখন পক্ষ-প্রতিপক্ষ হয়ে বিরোধে মত্ত থাকে, তখন তাদের মধ্যে বিবেক ও যুক্তি কাজ করে না। কাজ করে শুধু স্বার্থান্ধ আবেগ।বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১১) থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত জাগ্রত ছিল; তারপর দেশের ভেতরকার এবং বাইরের নানা ঘটনার অভিঘাতে সেই গণজাগরণের অবসান ঘটে।
দেশে রাজনৈতিক সংকটের মূলে আছে নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে আস্থাহীনতা। সেটা জাতীয় নির্বাচনই হোক আর স্থানীয় নির্বাচন। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে কিংবা কার অধীনে হবে-এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না। এ অবস্থায় মনে রাখতে হবে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশা করে সাধারণ মানুষ। মূলত দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় স্বার্থে সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোকে দ্রুত হীন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ আগামী নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা যায় সেই ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরও পড়ুন: বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা
কেননা নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য না হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনগণের রায় প্রকাশের পথ রুদ্ধ হয়। ফলে সমাজ ও দেশে অপশক্তি ও অনিয়মতান্ত্রিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সমাজে বাড়বে নানা অসঙ্গতি যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অনিশ্চয়তার পথ সৃষ্টি করবে। ইন্টারনেট-বিপ্লবের পর বিশ্ব এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে, তেমনি খুলে দেবে সম্ভাবনার দ্বার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বর্তমানে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। খাদ্যেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে চাল ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় ও আলু উৎপাদনে সপ্তম। করোনাকালের অব্যবহিত পূর্বে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশের নিচে এবং অতি দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ।
আরও পড়ুন: সমুদ্রের অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছে রহস্য
২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অতি দারিদ্রের হার ছিল ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ১ লাখ ১৮হাজার ৮১৩ বর্গকিমি. সমুদ্র এলাকার ওপর অধিকার অর্জিত হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ যা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল চালু হয়েছে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানকে আরো গতিশীল করে তুলেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আবাসনের লক্ষ্যে বরাদ্দ প্রধান করা হচ্ছে। ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবাররা পাচ্ছেন জমি ও ঘর। দেশের জন্যসংখ্যার প্রায় শতভাগ বিদ্যুৎ-সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৫৬০টি মডেল মসজিদ কাম ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে যেখানে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। শহরের সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মানের উন্নয়নে ইতোমধ্যে গ্রামে শহরের প্রায় সকল সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে গেছে।
এছাড়াও পদ্মা বহুমুখী সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্যানেল সহ এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ হবে আধুনিক রাষ্ট্র। অফুরন্ত জীবনীশক্তিতে বলীয়ান তরুণ প্রজন্মই পারে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন। তারুণ্যের শক্তিই পারবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। আমাদের চোখে এখন উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন। উদারবাদী গণতন্ত্র ও অপরিকল্পিত অর্থনীতির জায়গায় দরকার সর্বজনীন গণতন্ত্র ও পরিকল্পিত অর্থনীতি। রাজনৈতিক চিন্তায় জনসম্পৃক্তি দরকার। সরকারকে ধরাশায়ী করা এবং ক্ষমতায় গিয়ে শুধু অর্থবিত্ত অর্জন করা ও ক্ষমতা ভোগ করার এটাই তো রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। জনগণের ভেতর থেকে উন্নত মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা দরকার। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে সরকারকেই প্রয়োজনীয় করণীয় ঠিক করতে হবে। জনগণকে সব ধরনের অনিশ্চিয়তার হাত থেকে শঙ্কামুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি দেশের অগ্রগতিতে সরকারকেই অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে যা এ মুহূর্তে অধিক জরুরি। পরিশেষে আমরা চাই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে। এক্ষেত্রে কোন আপোষ নেই।
লেখক :
প্রাবন্ধিক, সাবেক কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সহ-সভাপতি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ’৭১, সভাপতি, চট্টগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লিঃ।