গাজীপুরের বরমা গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে স্ট্রবেরি চাষ
নিজস্ব প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২
গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমা গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে স্ট্রবেরি চাষ করা হচ্ছে ফ্রান্স, চিলি ও র্জেন্টিনার সুস্বাদু ফল স্ট্রবেরি। মৌসুমের শুরুতে সাদা ফুল ফোটে, পরে হলুদ রঙের ফল ধরে। সবশেষে পাকা লাল টুকটুকে রঙ ধারণ করে স্ট্রবেরি বাগানে।এ সময় প্রতিদিন জমি থেকে পাকা ফল সংগ্রহ ও তা বাজারজাত করণের সুবিধা থাকায় কাঁচা টাকা গুণছেন চাষীরা। প্রচুর ফলনে অধিক লাভ ও উচ্চ বাজারমূল্যের কারণে স্ট্রবেরি চাষে মনোযোগী হচ্ছেন এ গ্রামের চাষীরা।
গাজীপুরের শ্রীপুরের বরামা ও কাপাসিয়ার সিংহশ্রী এলাকায় স্ট্রবেরি চাষের বিস্তৃতি ঘটছে। কেউ কেউ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে স্ট্রবেরি চাষ করছেন।
শ্রীপুরের বরমী ইউনিয়নের বরামা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক ইসরাইল মিয়া বলেন, ২০০৯ সালে আমার ছোট ছেলে মোশারফ হোসেন ময়মনসিংহ থেকে স্ট্রবেরি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। কিন্তু তখন দেশে স্ট্রবেরির জাত আসেনি। দুই বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক হাজার স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করেন। ওই বছর রোপণ করে এলাকা ও সারাদেশে স্ট্রবেরি চাষের খবর ছড়িয়ে পড়ে। তার এ চাষ দেখে আশপাশের অনেকেই স্ট্রবেরি চাষে উৎসাহিত হয়। এখন বরামা দক্ষিণপাড়া গ্রামটি স্ট্রবেরি চাষের গ্রাম হিসেবে পরিচিচি পেয়ে গেছে। ছেলে চাকরিতে যোগদান করায় এ বছর আমি নিজেই ৫০ শতাংশ জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করেছি। তবে ১৫ শতাংশ জমির ফলন পঁচে গেছে। ২০ কেজি স্ট্রবেরি সংগ্রহ করতে পারেন। পাখি ছাড়া ক্ষতি করার মতো প্রাণি নেই। নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দিয়ে সার, কীটনাশক প্রয়োগ করেন। কৃষি বিভাগের লোকজন তার চাষ দেখতে আসেন। কিন্তু তাদের পরামর্শ স্ট্রবেরি চাষের জন্য যথাযথ নয়।
চাষীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘সেঞ্চুয়েশন’ জাতের স্ট্রবেরি চাষ করে আমার মত এলাকার অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। তাই এ জাত বাদ দিয়ে ভিন্ন জাতের স্ট্রবেরির চাষাবাদের পরামর্শ দিয়েছেন।
বরামা গ্রামের রুবেল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন। তিনি জানান, ৬ বছর যাবত স্ট্রবেরি চাষ করেন। অন্যান্যবার ৩০ শতাংশ জমিতে চাষ করতেন। প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে প্রায় তিনগুণ লাভ হওয়ায় এবার ৩৫ শতাংশ জামিতে চাষ করেন। কিন্তু তার জমিতে রোপন করা ‘সেঞ্চুয়েশন’ জাতের স্ট্রবেরি চারাগাছে ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। গাছে শেকড়পঁচা রোগ দেখা দিয়েছে। আক্রান্তের দু’ তিনদিনের মধ্যে গাছের পাতা কালো হয়ে যাচ্ছে। ওইসব গাছের অর্ধেক শেকড় পঁচে গেছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহারের পরও নিরাময় পাচ্ছেন না।সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারাগাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
অপর এক স্ট্রবেরি চাষী বরামা গ্রামের আব্দুস ছাত্তারের ছেলে সাইফুল ইসলাম জানান, তিনি ১১ বছর যাবত স্ট্রবেরি চাষ করছেন। প্রতিবেশী মোশারফ হোসেনের স্ট্রবেরি চাষাবাদ দেখে পরের বছর থেকে তিনি নিজেই চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথমে বারি-৩ জাতের স্ট্রবেরি আড়াই কাঠা জমিতে চাষ করেন। এতে তার ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়। পরের বছর ‘ফেস্টিভাল’ নামের আরো একটি জাতের চাষ করেন। লাভজনক হওয়ায় দ্বিতীয় বছর ৩৫ শতাংশ জমিতে চাষ করেন এবং উৎপাদিত স্ট্রবেরি সাড়ে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। দ্বিতীয় বছর নিজেই চারা উৎপাদন ও সংরক্ষণ করেন। এভাবে বছরের পর বছর ধরে স্ট্রবেরি চাষ করে যাচ্ছেন। এ বছর ৪০ শতাংশ জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করছেন।
তিনি জানান, ‘উইন্টারডন’ জাতের স্ট্রবেরি চারাগাছ গাজীপুরের পরিবেশের সাথে বেশ ভাল মানিয়েছে। এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। ফলের রঙ উজ্জ্বল এবং আগাম উৎপাদন হয়। ‘ফেস্টিভাল’ জাতে ফল উৎপাদনে দেরী হয়। ফলে বৃষ্টি ও বিরূপ আবহাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘উইন্টারডন’ জাতের একটি চারাগাছ থেকে মৌসুমে কমপক্ষে দুই কেজি ফল পাওয়া যায়। ৩৫ শতাংশ জমিতে ৫ হাজার স্ট্রবেরি চারা রোপণ করা যায়। প্রতি শতাংশ জমিতে সাড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ হয়।
তিনি আরো বলেন, কার্ত্তিক মাসে জমিতে চারা রোপন করতে হয়। পৌষের মাঝামাঝি সময় থেকে ফলন আসে। চৈত্র মাস পর্যন্ত ফল বিক্রি করা যায়। গত বছর ২ লাখ টাকা খরচ করে ৩০ শতাংশ জমি থেকে ৬ লাখ টাকার ফল বিক্রি করেছেন। এবার ৪০ শতাংশ জমি থেকে আরো বেশি বিক্রি এবং লাভের প্রত্যাশা তার।
চাষী ইমাম উদ্দিন জানান, এবার সেঞ্চুয়েশন জাতের স্ট্রবেরি চারা লাগিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। তিন লাখ টাকা ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার কোনো উপায় নেই।
একই এলাকার চাষী দুদু মিয়াসহ অন্যান্যরা বলেন, স্ট্রবেরি চাষ অনেক লাভজনক। যারা স্ট্রবেরি চাষ করছেন, প্রত্যেকেই বছরে কমপক্ষে ২-৩ লাখ টাকা লাভ করছেন। এলাকার চাষীরা প্রতিদিন সকালে একসাথে গাড়িতে করে ঢাকার আব্দুল্লাহপুর, কারওয়ান বাজার, গাজীপুরের বাইপাস ফলের আড়তে স্ট্রবেরি বিক্রি করেন। তারা জমি থেকে প্রতি কেজি ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করেন।
পার্শ্ববর্তী উপজেলা কাপাসিয়ার সিংহশ্রী গ্রামের বিদেশ ফেরত আরিফুল ইসলাম প্রধান জানান, গত ৫ বছর যাবত তিনি স্ট্রবেরি চাষ করছেন।স্ট্রবেরি চাষ প্রায় চার মাস মেয়াদী লাভজনক একটি ফসল। চার মাস পরিশ্রম করলে তিনগুণ লাভ করা সম্ভব। এখন রাজশাহী থেকে স্ট্রবেরির চারা সংগ্রহ করতে হয় না। এলাকাতেও চারা পাওয়া যায়। জমিতে রোপনের খরচসহ একেকটি চারার মূল্য দাঁড়ায় ৪০ টাকা।
এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জনবাণীকে বলেন, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের দক্ষিণ বরামা গ্রামে ও কাপাসিয়া উপজেলার সিংহশ্রী গ্রামে বেশ কয়েকজন চাষী স্ট্রবেরি চাষ করছেন। দ্রুত পঁচনশীল হলেও এটি অধিক লাভজনক ফসল। সাধারণত ছত্রাকের আক্রমণ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের সমস্যা হয় না। ছত্রাক থেকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনমত ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে রোগবালাই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এসএ/