দশ বছরের শিশু এখন ৩৬ বছরের যুবক
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭:১৫ অপরাহ্ন, ২১শে জুলাই ২০২৩
দশ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফেরত পেয়েছেন তার পরিবার। এখন সে ৩৬ বছরের যুবক। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁও উপজেলা সদরের আখানগর ইউনিয়নের দেবীডাঙ্গা গ্রামের শহিদুল ইসলামের বড় ছেলে মতিউর রহমান।
২০০২ সালে তিনি নিখোঁজ হন। মানসিক অসুস্থ্য থাকলেও তখন সে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। পরিবারের ধারণা, ঠাকুরগাঁওয়ের আখানগর ইউনিয়নের কান্তিভিটা ধোনতলা সীমান্ত হয়ে ভারতের পাচির সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতের উত্তর দিনাজপুরে প্রবেশ করেন মানসিক বিপর্যস্থ মতিউর রহমান।
দীর্ঘ ২১ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মতিউর রহমানকে (৩৬) অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার সন্ধান পাননি পরিবার। তবে ছেলেকে ফিরে পাবার অপেক্ষা থেকে বিচ্যুতি হননি তারা। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে। মতিউর ফিরে এসেছে পরিবারের কাছে।
শুক্রবার (২১ জুলাই) বিকেলে ভারত থেকে দেশে ফিরেন মতিউর। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে দেশে আসলে তাকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে তুলে দেন ইমিগ্রেশন পুলিশ। এ সময় সৃষ্টি হয় এক আবেগঘণ মুহূর্ত। সন্তানকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে আনন্দে কান্না শুরু করেন বাবা-মা ও স্বজনরা।
মতিউর রহমান ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে হারিয়ে যান। সেসময় ঠাকুরগাঁও সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তার বাবা সহিদুল ইসলাম। এরপর সারা দেশে খুঁজেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ২১ বছর পর হারানো ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে ভাসছে বাবা-মা।
পরিবারের সদস্য ও বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে মতিউর রহমানকে উদ্ধার করেন ভারতের ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন’ এর সমাজকর্মীরা। উদ্ধারের পর ওই সংস্থার পক্ষ থেকে মানসিক বিপর্যস্থ মতিউরের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। এরপর তাকে সিজোফ্রোনিয়া রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
পরে শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার মাধ্যমে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তিনি কিছুটা সুস্থ্য হয়ে উঠেন। সুস্থতার পর তার কাছেই পরিবারের পরিচয় জানতে পারেন ফাউন্ডেশনের কর্তাব্যক্তিরা। এরপর সেখানকার সমাজকর্মী নীতিশ শর্মা বাংলাদেশের তার দুই বন্ধুর মাধ্যমে মতিউরের পরিবারের খোঁজ পান তাদের সহযোগিতায় প্রথম ভিডিও কলের মাধ্যমে বাবা মাসহ পরিবারের সদস্যদের সাথে কথাও বলেন মতিউর।
এরপর দুই দেশের আইনি প্রক্রিয়া শেষে ফেরত আসেন মতিউর রহমান। তাকে কাছে পেয়েই বুকে জড়িয়ে নেন বাবা মাসহ মতিউরের স্বজনরা।
২১ বছর পর দেশে প্রবেশ করে মতিউর রহমান বলেন, আমি কখন ভারতে গিয়েছি, কিভাবে গিয়েছি কিছই মনে নেই। ভারতে শ্রদ্ধা ফাউন্ডেশন সংস্থায় আমার চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এরপর আমি আমার পরিচয় দিলে তারা দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘদিন পর দেশে আসতে পেরেছি, বাবা মাকে কাছে পেয়েছি এজন্য আমার খুব ভালো লেগেছে।
মতিউরের মা মর্জিনা বেগম বলেন, আমি আমার হারানো কলিজার টুকরাকে কাছে পেয়েছি। আল্লাহর কাছে আর কিছুই চাই না। যারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে চিকিৎসা করে আমাদের কাছে ফেরত দিয়েছে তাদের প্রতি আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
আরও পড়ুন: পঞ্চগড়ে আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন মিছিল
মতিউর রহমানের বাবা শহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। ২০০২ সালে তার বয়স ১৫ বছর ছিল। তখন সে নিখোঁজ হন। আট মাস আগে জানতে পারি সে ভারতের শ্রদ্ধা পুর্নবাসন ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং সেখানে চিকিৎসা শেষে সে সুস্থ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন পর ছেলে ফেরত পাওয়ার জন্য আমি বাংলাদেশ সরকার, ভারতসহ সেখানকার শ্রদ্ধা ফাউন্ডেশনের সমাজকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ভারতের শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন এর সমাজকর্মী নিতীশ শর্মা বলেন, ২০১৯ সালে আমরা মহারাস্ট্র থেকে রাস্তায় ঘোরাঘুরির সময় মতিউর রহমানকে উদ্ধার করি। আমরা মূলক রাস্তা ঘাটে মানসিক অসুস্থদের উদ্ধার করে চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন করি। সুস্থতার পর এমন অনেককে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এর আগে নেপালেও আমরা কয়েকজনকে সুস্থ্য করে পরিবারের কাছে ফেরত দিয়েছি। তবে এবারই প্রথম কোন বাংলাদেশের অসুস্থ্য মানুষকে ভারতে উদ্ধার করে চিকিৎসার পর দেশে ফেরত দেওয়া হলো।
বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. খায়রুল ইসলাম বলেন, মতিউর রহমানের বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই দেশের হাইকমিশনার পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় ভারত থেকে তাকে ফেরত আনা হয়েছে। ভারতের ফুলবাড়ি ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের কাছে তাকে হস্তান্তর করেন। এরপর আইনি প্রক্রিয়া শেষে ভারতের একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে সক্ষম হই।
জেবি/ আরএইচ/