তরুণ কিশোর-কিশোরীদের উপর সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীলতার প্রভাব


Janobani

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০১:৪৫ অপরাহ্ন, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২২


তরুণ কিশোর-কিশোরীদের উপর সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীলতার প্রভাব

সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ফেসবুকের টাইমলাইন, নিউজফিড অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার বর্তমান সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।  যা আমাদের তরুণদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরফলে ফেসবুক ব্যবহারের সাথে যুক্ত তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীল চ্যাট, শেয়ার, ভিডিও কল তরুণ ও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে এক নেতীবাচক প্রভাব নিয়ে আসছে।  সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নারীর অশ্লীল শরীরের চিত্র ও ভিডিও প্রচার এবং তা দর্শন করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে  অশ্লীল অবাস্তব প্রত্যাশা, ঝুঁকি, আচরণের অস্বাভাবিককরণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে আসছে। এতে নারীরা বিশেষ করে ঝুঁকির সম্মূখীন হচ্ছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে , কিশোর-কিশোরীদের ঐ বয়সে মানসিক স্বাস্থ্য বিকশিত হতে থাকে এবং ব্যক্তি হিসাবে তাদের নিজস্ব পরিচয় বিকাশ লাভ করে। বয়ঃসন্ধিকাল ঝুঁকি গ্রহণের একটি সময়, যা একদিকে শক্তি এবং দুর্বলতা উভয়ই। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুকের অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার তরুণ প্রজন্মের মানসিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন আমরা বর্তমানে তরুণদের অপরাধ প্রবনতার বৃদ্ধি দেখেছি।

ড. শ্যারন কুপার, ফরেনসিক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অফ মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি সদস্য, বলেছেন "ছবি অবশ্যই কিশোর-কিশোরীদের প্রভাবিত করে" এবং কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্ক পর্নোগ্রাফি থেকে অস্বাস্থ্যকর যৌন ছবি গ্রহণ করে ৷ ড. কুপারের মতে, পর্নোগ্রাফি যৌনতাকে অস্বাভাবিক করে তোলে এবং অরক্ষিত যৌন যোগাযোগ,  সহিংসতা এবং ধর্ষণের মতন ঘটনাকে উৎসাহিত করে । ডাঃ কুপার যুক্তি দেন যে, কিশোর-কিশোরীরা পর্নোগ্রাফিক ইমেজগুলির জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকে কারণ মস্তিষ্কের মিরর নিউরনগুলির কারণে।  কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে শিখে তাতে মিরর নিউরন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং পর্নোগ্রাফি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে ৷ এরফলে তরুণ প্রজন্মের মাঝে নারীদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখা প্রবনতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে পাবলিক প্লেসে নারী ও মেয়েদের যৌন হয়রানির বৃদ্ধির সোশ্যাল মিডিয়া ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ছবি নারীদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখাতে ভূমিকা রাখচ্ছে এবং তরুণ প্রজন্মের যৌন আচরণকে প্রভাবিত করছে। তরুণদের সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুকের অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও দেখা ভবিষ্যতের যৌন আচরণ এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করে। যা নারীদের প্রতি আগ্রাসী হতে এবং অবজ্ঞা করতে প্ররোচিত করে। যা তাদের শেখাতে পারে যে আক্রমনাত্মক আচরণ করা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং এমনকি কাম্য। যা নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং আচরণকে আকার দেয়। ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক এবং ইউটিউবে যৌনতাযুক্ত ছবি এবং সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত থাকা, কিশোর-কিশোরীদের আচরণ এবং মনোভাবের উপর নেতিবাচক বা অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলছে।  

তরুণরা সামাজিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি কিশোর-কিশোরীরা অবাস্তব 'হালকা-পাতলা' বা 'পেশীযুক্ত' শরীরের ধরনগুলি অনুসরণ করে, তবে তা তাদের ডায়েটিং আচরণের উপর প্রভাব ফেলবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনধারা সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, উদাহরণস্বরূপ জাঙ্ক ফুড খাওয়া, ধূমপান, অ্যালকোহল পান এবং অন্যান্য মাদক গ্রহণ । সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রাক-কৈশোর এবং কিশোর-কিশোরীদের কেনার প্রবণতাকেই প্রভাবিত করে এবং তাদের মতামতকেও প্রভাবিত করে৷

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনীতিবিদ, পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রিটি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য 'ভুয়া খবর' বা পক্ষপাতদুষ্ট বা ঘৃণাপূর্ণ মনোভাব প্রচার, সাইবার বুলিং ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে অন্য ব্যক্তির সম্পর্কে বা সরকারের সম্পর্কে বা কোন বিষয়ে মিথ্যা, বিব্রতকর বা প্রতিকূল তথ্য দিয়ে সমস্ত কিশোর-কিশোরীদের ভুলপথে চালিত করছে।

বর্তমানে ফেসবুক ডিপ্রেশন বা "ফেসবুক বিষণ্ণতা" যা কিশোর-কিশোরিদের বিষণ্নতা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলিতে প্রচুর সময় ব্যয় করার ফলে বিষণ্নতার লক্ষণগুলি প্রকাশ করে। অফলাইন বিষণ্ণতার মতো, প্রাক-কৈশোর এবং কিশোর-কিশোরীরা যারা Facebook বিষণ্ণতায় ভোগে তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিতে থাকে এবং কখনও কখনও আক্রমণাত্মক বা আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণ করতে। কিশোর-কিশোরীদের বিকাশমান মস্তিষ্কই অনলাইনে অনেক বেশি সময় থাকার ফলে বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে। সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার সামাজিক কার্যকলাপ হ্রাস এবং একাকীত্ব বৃদ্ধি সহ বিষণ্নতার লক্ষণগুলো তীব্রতর করে। সোশ্যাল মিডিয়ার দীর্ঘায়িত ব্যবহার হতাশা, উদ্বেগ এবং কম আত্মসম্মানবোধের লক্ষণ ও উপসর্গের সাথে সম্পর্কিত। কিশোর-কিশোরীরা প্রায়ই তাদের সামাজিক মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলিতে আবেগগতভাবে পোস্ট করার তাড়না অনুভব করে। তারা অনলাইনে দ্রুত সাড়া পাওয়ার চাপ অনুভব করে। তারা নিখুঁত ফটো এবং ভাল-লিখিত পোস্টের জন্য চাপ অনুভব করে, যার সবগুলিই অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ হয়। প্রকৃতপক্ষে, একজন কিশোর-কিশোরীর সামাজিক বৃত্ত অনলাইনে যত বড় হয় তারা অনলাইনে সবকিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলার ব্যাপারে তত বেশি উদ্বেগ অনুভব করে। ফলস্বরূপ, এটি কিশোর-কিশোরীদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা উদ্বেগের অনুভূতি সৃষ্টি করে। অনেক কিশোর-কিশোরী, বিশেষ করে মেয়েরা, অন্যরা তাদের সম্পর্কে কী ভাববে এবং তারা যখন তাদের পরবর্তীতে দেখবে তখন তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।

কখনও কখনও কিশোররা সোশ্যাল মিডিয়াতে এত বেশি ঘন্টা ব্যয় করে যে তারা মূল্যবান ঘুম হারাতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, এই ঘুমের ক্ষতি মেজাজ, গ্রেড হ্রাস, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং অতিরিক্ত খাওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং মনোযোগের ঘাটতি হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (ADHD) এর মতো বিদ্যমান সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলে। যেমন ফোকাস করতে অসুবিধা, মানসিক নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল মনোযোগ, হাইপারঅ্যাকটিভিটি এবং পর্যাপ্ত ঘুম। সুতরাং, মধ্যরাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় লগইন করা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, ক্লান্ত এবং খিটখিটে বোধ করা ছাড়াও, ঘুমের অভাব দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে এবং কিশোর-কিশোরীদের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন করে তোলে। ঈর্ষা এবং হিংসা—যদিও স্বাভাবিক আবেগ—তবুও ফেইসবুকের পোষ্ট দেখে তারা তাদের সমবয়সীদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে, যা কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কে বিপর্যয় ঘটাতে পারে। অন্য কারোর যা আছে বা অভিজ্ঞতা আছে তার নেই, এই ধরণের তুলনা তাকে অতি মাত্রায় বিষণ্ণ করে তুলে। ফেইসবুকে সবাই যা পোষ্ট করে, যাতে প্রদর্শিত হয় যে সে অন্যদের চেয়ে বেশি উত্তেজনাপূর্ণ বা আনন্দদায়ক জীবনযাপন করে। দুর্ভাগ্যবশত, কিশোর-কিশোরীরা প্রায়শই বুঝতে পারে না, লোকেরা শুধুমাত্র তাদের "হাইলাইট রিল" সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে এবং প্রায়শই জাগতিক বা কঠিন অভিজ্ঞতাগুলিকে ইন্টারনেটের বাইরে রাখে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে- facebook, messanger, google, instagram, linkedln, pinterest, tumbler, snapchat, twitter, viber, wechat, whatsApp, youtube ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে facebook। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার (জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৩ শতাংশ)। করোনার সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে দেশে মেসেঞ্জার ব্যবহার করতেন ৯৩ লাখ ৯১ হাজার মানুষ। এক বছরে এ সংখ্যা সাড়ে চার গুণ বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ২১ লাখ ৫০ হাজার। এই সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীদের মধ্যে পুরুষ ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং নারী ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ এবং সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারীর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এই সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। ব্যবহারকারীর মধ্যে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ নারী এবং পুরুষ ৬৯ দশমিক ১ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১৮ থেকে ২৪ বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি। তাঁদের সংখ্যা ২ কোটি ১২ লাখ।

উপসংহারে বলতে হয় সরকারকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ফেসবুকের টাইমলাইন, নিউজফিডে অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার প্রদর্শনী বাংলাদেশে বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পিতামাতাদের উচিত তাদের তরুণ ও কিশোর-কিশোরী সন্তানদের সামাজিক মিডিয়ার ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া এবং অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহার করা হলে তাদের উপর এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তাদের  সতর্ক করা । শিক্ষার পাঠ্যক্রমটিও সংশোধন করা উচিত যাতে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা যায় যে তাদের সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।

লেখক: অভিজিৎ বড়ুয়া অভি। কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

এসএ/