নৌপথে বিআইডব্লিউটিএ'র বৈপ্লবিক পরিবর্তন
মো. রুবেল হোসেন
প্রকাশ: ১২:৪৫ অপরাহ্ন, ২৬শে ডিসেম্বর ২০২৩
নদী পথের নাব্যতা রক্ষা ও নদী খননের মাধ্যমে নৌপথে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহন ব্যবস্থা সূদৃঢ় করতে কাজ করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নদীকে ঘিরে দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ জনগণ কৃষি, মৎস্য, পর্যটন, যাতায়াত, পণ্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ ব্যক্তি জীবনে স্বচ্ছলতা এনে আত্ম-সামাজিক উন্নতি সাধিত হচ্ছে বহুকাল হতে। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন ও নৌপথের উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিআইডব্লিউটিএ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ)।
অভ্যন্তরীণ নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কিলোমিটার নৌপথ নতুন ভাবে সৃষ্টি হয়েছে। ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে উন্নীতকরণের প্রকল্প চলমান রেখেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় যা বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল অব্যাহত রাখতে ৬ হাজার কিলোমিটার নৌ পথের নাব্যতা রক্ষায় ড্রেজিং করতে ৩৮টি ড্রেজার ও ২৩৮টি আনুষঙ্গিক জলযান সংগ্রহ করছে বিআইডব্লিউটিএ যা বাস্তবায়ণ করছে সংস্থাটির ডেজিং বিভাগ। কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সংস্থাটির অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। নৌপথে বিআইডব্লিউটিএ'র বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে।
আরও পড়ুন: বিআইডব্লিউটিএতে শেখ রাসেলের জন্মদিন পালন
গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকার চারপাশের নদীর দূষণরোধ ও নাব্যতা রক্ষার লক্ষ্যে প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান সংশ্লিষ্ট প্রকল্প গ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্তবিষয়ক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,আমাদের (নদী) ডেজিং করতে হবে এবং নাব্যতা বজায় রাখতে হবে। নদী ভাঙন রোধকল্পে আমাদের ডেজিং করতে হবে। দেশ বাঁচাতে হলে নদী বাঁচাতে হবে।
১৯৬০ সালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, চাঁদপুর ও টঙ্গী এই ছয় নদীবন্দর প্রতিষ্ঠা হয়। সারাদেশে সরকার অনুমোদিত মোট নদীবন্দর রয়েছে ৪৩টি। চলতি বছরে পাবনার নাজিরগঞ্জে সর্বশেষ নদী বন্দর প্রতিষ্ঠা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ’র উন্নয়ন, আর্থিক ও প্রশাসনিক সংক্রান্ত বৈঠকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নৌপথ আরো আধুনিকায়ন করে জীবনমুখী করা হবে। এ সক্ষমতা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) আছে। সে অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে।
নৌপথে পণ্য পরিবহন ও চলাচলে আধুনিক এবং যাত্রী বান্ধব করতে ২৫টি পুরাতন নদী বন্দরকে আধুনিক করার পাশাপাশি নতুন ১৮টি নদী বন্দর স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে ১৩৬টি নতুন জেটি ও ১৬টি গ্যাংওয়ে নির্মাণ করেছে সংস্থাটি। জানা যায়, খননযন্ত্র ও ড্রেজার স্বল্পতার কারণে আগে নদী খনন ও ড্রেজিংয়ের কাজ ব্যাহত হলেও এখন তেমন কোনো সঙ্কট নেই। ডেজিং বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রকিবুল ইসলাম তালুকদার যার কর্ম প্রচেষ্টায় বাংলার নদী গুলো ডেজিংয়ের মাধ্যমে চিরচেনা রূপ ফিরে পাচ্ছে।
ঢাকা, বরিশাল, পটুয়াখালী নদী বন্দরকে আধুনিক নদী বন্দরে রূপান্তর করার পাশাপাশি নোয়াপাড়া, ভৈরব, আশুগঞ্জ, বরগুনা, ভোলা, নগরবাড়ী, মেঘনা, ঘোড়াশাল, কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ নদী বন্দর স্থাপনের কার্যক্রম চালু রয়েছে বলে জানা যায়। দেশের এ সকল নদী বন্দর দেখভাল করে সংস্থাটির বন্দর ও পরিবহন বিভাগ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো এলাকায় নদীবন্দর করা হলে জনসাধারণের পাশাপাশি নৌপথ সংরক্ষণেও সেটি কাজ করে। কারণ, বন্দর চালু রাখতে নিয়মিত বিরতিতে বা প্রয়োজন অনুযায়ী নদী খনন বা পুনঃখনন করতে হয়। যাতে নদীর নাব্যতা ঠিক থাকে ও নৌযান চলাচল করতে পারে। পাশাপাশি নদীবন্দর ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিআইডব্লিউটিএ'র রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। ফলে নদীবন্দরে নৌপথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সহজ হয়। সংস্থাটির বন্দর ও পরিবহন বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মো: সাইফুল ইসলাম যার প্রচেষ্টায় বিআইডব্লিউটিএ রাজস্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
জানা যায়, বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় দু'টি আধুনিক কার্গো টার্মিনাল, তিনটি প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ও একটি আধুনিক নৌ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন এবং দক্ষিনাঞ্চলসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ১৫টি জেটি, ল্যান্ডিং স্টেশন ও ভেসেল শেল্টার সেন্টারসহ নৌ-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
আরও পড়ুন: বিআইডব্লিউটিএ'র অভিযানে শীতলক্ষ্যায় ৪ নৌযানকে অর্থদণ্ড
সারাদেশে অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রায় ৪৮০টি ঘাটে ১৮২টি পন্টুন স্থাপন এবং ৪৫০টি পন্টুন ডকিংয়ে স্থাপন করা হয়েছে। একই সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচল সহায়তার লক্ষ্যে লাইটেড বয়া ৫০টি, স্কেরিকেল বয়া ৫০টি, ডিজিটাল গেজ স্টেশন ৫৩টি ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপিত হয়েছে।
এছাড়াও পল্লী অঞ্চলের ঘাট সমূহে এসপি পন্টুন ৫০টি, ফেরী পন্টুন ১১টি, এমপি পন্টুন ৪৫টি স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিনত হয়েছি আমরা, আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে নদী বন্দর সমূহে। বিআইডব্লিউটিএ'র অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করে সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগ। দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো নির্মাণে ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ। এই বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন মো: মহিদুল ইসলাম।
নৌপথে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি ৫৫ ধরনের মালবাহী নৌযান-রুট পারমিটের আওতায় এসেছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত নৌপথে ৪১ কোটি মেট্রিক টন পণ্য এবং ৩১৫ কোটি যাত্রী যাতায়াত করেছে। এছাড়াও বাংলাদেশ-ভারত নৌ-ট্রান্সশিপমেন্ট চালু করে। কোলকাতা-আশুগঞ্জ-ত্রিপুরা নৌপথ ও সড়কপথে পণ্য পরিবহন এবং পর্যটন ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়েছে।
নদী পথের নাব্যতা রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে নৌরুট চিহ্নিতকরণে অভ্যন্তরীণ নৌপথে ২৯ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এবং উপকূলীয় নৌপথে ৮ হাজার ২৫০ কিলোমিটার হাইড্রোগ্রাফিক জরীপ সম্পন্ন করেছে হাইড্রোগ্রাফি বিভাগ।
নদী দূষণ রোধকল্পে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদী হতে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। ঢাকা শহরের চারদিকে প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে তুরাগ নদীর বর্জ্য অপসারণ চললাম রয়েছে। এছারাও সারাদেশের নদী তীরভূমি রক্ষায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ একর ভূমি উদ্ধার। উদ্ধারকৃত জমিতে ৭ হাজার সীমানা পিলার স্থাপন, ১০ হাজার বৃক্ষরোপন, ৪০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে, ৬টি জেটি, ৩টি ইকোপার্ক নিমার্ণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ।
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে নৌ-দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে ৬৬০টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা যান প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ; আহত হয়েছেন অসংখ্য। দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ হয়েছেন আরও প্রায় ১ হাজার ৬০০ জন। ২০১৫ সালের পর দেশে থেমে থাকেনি নৌ-দুর্ঘটনা। প্রতি বছরই হচ্ছে নৌ-দূর্ঘটনা।
এ সকল দূর্ঘটনা হ্রাসে নারায়ণগঞ্জ ডিইপিটিসি-কে আরও আধুনিকসহ মাদারীপুর ও বরিশালে নতুন নৌ-প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে বিআইডব্লিউটিএ। নৌপথে দ্রুত উদ্ধার কাজ করতে ২৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন দু'টি উদ্ধারকারী জাহাজ রয়েছে এই সংস্থার দখলে এছাড়া আরও ১ হাজার ৫০০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন দু'টি উদ্ধারকারী জাহাজ সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। দূর্ঘটনা রোধে নৌপথে বা নৌ-সীমানায় বাতি-বয়াসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন ও সংরক্ষণের কাজ করে সংস্থাটির নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগ। এই বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন মো: শাহজাহান। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে নৌপথের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে এসেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সারাদেশে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থায় সেবা প্রদানের মাধ্যমে ঘাট-পয়েন্ট, নদীর তীরভূমি, লিজ লাইসেন্স প্রদানের মাধ্যমে গত ১৪ বছরে (২০০৯-২০২৩) প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। যা জাতীয় রাজস্ব খাতে ভূমিকা রাখছে। একটি প্রতিষ্ঠান সঠিক ও সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হতে হলে কয়েকটি স্তম্ভের উপর নির্ভর করতে হয় তার মধ্যে অন্যতম স্তম্ভ হলো প্রাতিষ্ঠানিক সিবিএ। বর্তমান বিআইডব্লিউটিএ সিবিএ ঠিক সেই কাজটিই করে চলছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সমন্বয়ে এক মেলবন্ধনে সরকারের উন্নয়নকে আরও তরান্বিত করছে।
আরএক্স/