প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের: ২৬ দখলদারের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮:৫৫ অপরাহ্ন, ১০ই জুলাই ২০২৪
কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবন কেটে চিংড়ি তৈরীর ঘটনায় ২৬ দখলদারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) এর ধারায় পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের পরিদশক ফাইজুল কবির বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
মামলা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহেশখালী থানার পরিদর্শক সুকান্ত চক্রবতী।
আরও পড়ুন: টেকনাফে অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার
মামলার আসামিরা হলেন, সাবের আহমেদ (৪৮), মহসিন আনোয়ার (৫০), ওসমান আলী (৬১), জসিম উদ্দীন (৪০), সাজেদুল করিম (৪৫), রবিউর আলম (৪২), মো. ফারুক (৪১), জাহাঙ্গীর আলম (৪২), জাফর আলম (৬০), মো. তারেক (৩৫), আমিরুজ্জামান (৬২), সাজ্জাদুল করিম (৩৮), নুরুল আমিন খোকা (৪১), মো. ছিদ্দিক রিমন (৩৯), শাহাদাত কবির (৪৫), সোনামিয়া (৩৭), নুরুল আমিন (সাবেক চেয়ারম্যান) (৬২), শহিদুল্লাহ সিকদার (৬৮), মো. নেজাম (৪৩), আমির হোসেন (৫৪), নাসির উদ্দিন (৫০), শফি আলম (৪৫), মো. আলম শরিফ (৪৭), জয়নাল আহমদ (৪৫), আমির হোসেন (কোম্পানী) (৪৮), আজিজুল হক (৪৬) সহ আরো অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজার মহেশখালী উপজলোর প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা সোনাদিয়া দ্বীপের ঘটিভাঙ্গা মৌজার ৫৬২ একর জায়গা গত জানুয়ারি হতে দিবা-রাত্রি প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের তৈরী করছিল একটি চক্র। তারা প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস, মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক কার্যাবলী, ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট নষ্টের কাযক্রম চালিয়ে আসছিলেন। যা বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষন আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) এর ধারা ৪(২), ৫ (৪), ১২, ধারা লঙ্ঘণ করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এবং একই আইনের ১৫(১) টেবিলের ক্রমিক নং ১, ২, ১২ অনুসারে দন্ডণীয় অপরাধ। এছাড়াও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ব্যবস্থাপনা বিধিমামালা, ২০১৬ এর ১৮ ধারালঙ্ঘণ করেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন যা একই বিধির ২৭ ধারা অনুসারে দন্ডনীয়।
এমতাবস্থায় বিভাগীয় কর্মকর্তার অনুমোদিত রিপোর্ট মতে দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর।
আরও পড়ুন: ‘প্রেমিকার আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও’ না দেয়ায় ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে বন্ধুকে হত্যা করে আরেক বন্ধু
জানা যায়, জানুয়ারি মাস থেকে সোনাদিয়ায় বাংলাদেশ অথনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) আওতাধীন বন কেটে ৪০-৪৫টি চিংড়ি ঘের তৈরি করে আসছিল প্রভাবশালীরা। দখলদারদের তালিকায় শীর্ষ ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছিল। সেখানে ম্যানগ্রোভ কাটার বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন, উপকূলীয় বন বিভাগ কক্সবাজার অফিসের বন সংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ।
বনবিভাগ সুত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত ১৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩ হাজার দখলদারকে আসামি করে ৪৮টি মামলা করেছিল বনবিভাগ। উদ্ধার করা হয় দেড় হাজার একর ভূমি।
বনসংরক্ষক শেখ আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। দখলকৃত বনভূমি এবং দখলদারদের তালিকা সংসদীয় কমিটি, মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনকে পাঠিয়েছিল উপকূলীয় বন সংরক্ষক।
বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) এর জেলা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, সোনাদিয়ায় প্রতিদিন ৩০-৪০টি স্থানে অবৈধভাবে এক্সকাভেটর দিয়ে বিধ্বংসী কমকান্ডে চালাচ্ছে দখলদারেরা। যার কারণে পরিবেশ সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় কমে যাচ্ছে ‘চামচটুটো বাটান’পাখি। শীতকালে সাইবেরীয় অঞ্চল থেকে যে পাখিগুলো আসতো এগুলো কমতে শুরু করেছে। এছাড়া বেশকিছু অমেরুদন্ডী প্রাণী, বিভিন্ন মাছ, কাঁকড়া হুমকির মুখে।
তিনি বলেন, এখানে ২ থেকে ৩শ প্রজাতির শামুক ঝিনুক এবং আড়াইশ থেকে তিনশ প্রজাতির মাছ এবং সত্তর প্রজাতির পাখি আছে। এই প্রাণীগুলোর নাসারি গ্রাউন্ড হলো ম্যানগ্রোভ।
আরও পড়ুন: কুতুবদিয়ায় মাসব্যাপি বৃক্ষরোপন কর্মসূচি উদ্বোধন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক পাল বলেন, ‘মহেশখালী দ্বীপের ম্যানগ্রোভ এবং পাহাড়ি বন কমে গেলে অধিক পরিমাণে তাপমাত্রা বাড়বে, ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হবে, জীববৈচিত্র্য ও প্রাণী বিলুপ্ত হবে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. শফীকুল ইসলাম বলেন, একশোটিরও বেশি গাছ ম্যানগ্রোভ বাস্তুতন্ত্রে জন্মায়। তার মধ্যে সুন্দরী, গরান, গেওয়া ও কেওড়া অন্যতম। বন বাস্তুতন্ত্রকে স্থিতিশীল করে ক্ষয় কমাতে সাহায্য করে। রক্ষাকবচ হিসেবে জনবসতিপূর্ণ এলাকার ক্ষতি রোধ করে। সাইক্লোন-হারিকেনের মতো ঝড়ের প্রভাব শোষণ করে।
চবি’র এই অধ্যাপক দখল, চোরাশিকার কৃষি, শিল্পের কারণে সৃষ্ট দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ও ইকোট্যুরিজম এবং আগুন লাগানোসহ অন্যান্য হুমকিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুর বলে মনে করেন।
ধরার সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, বন আদালতে দখলদারদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা চলমান সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। দখলদারদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এবং বন ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে সচেতন সম্পৃক্ত করতে হবে।
এমএল/