ডিপিডিসির হুজ্জাতের টাকার মেশিন!


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬:১০ অপরাহ্ন, ১৩ই জুলাই ২০২৪


ডিপিডিসির হুজ্জাতের টাকার মেশিন!
ছবি: জনবাণী

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহ’র  ঘরে আলাদিনের চেরাগ। জমির দালালি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন এই দাপুটে কর্মকর্তা। ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জালিয়াতি ও দুর্নীতির শীর্ষ ডিপিডিসির হুজ্জাত উল্লাহ। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ধোপাকান্দি ইউনিয়নের বেতবাড়ি এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। 


তিনি মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে। বাবা পেশায় একজন ছিলেন কৃষক। আর ছেলে এখন টাকার মেশিন।  হুজ্জাত উল্লাহ গ্রামে টিনের ঘর থাকলেও ঢাকায় আলিশান জীবন-যাপন করেন তিনি। ছেলে বসবাস করেন জাপান শহরে। সেখানে গড়েছেন রাজমহল। চড়েন বিলাশবহুল গাড়িতে। 


হুজ্জাতের অর্থাভাবে এক বেলা হাঁড়ি চড়ে তো আরেক বেলা উপোস থাকতে হতো। সেই মানুষটিই হঠাৎ করে কয়েক বছরের ব্যবধানে কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকার বনশ্রী ও খিলক্ষেতে একাধিক ফ্ল্যাট, কক্সবাজারে রয়েছে হোটেলে পাঁচ শেয়ার, দামী গাড়ি-সে এক এলাহী কাণ্ড! সম্পদহীন মানুষটি কোন আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পেয়ে এভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেলেন-এমন প্রশ্ন আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিতমণ্ডলের সর্বত্র। সরেজমিনে ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে নেপথ্য কারণটা অবশেষে জানা গেছে। হুজ্জাত উল্লাহ’র এই আলাদিনের চেরাগ আর কিছু না, জমির দালালি। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে অন্যের জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক দেখিয়ে টাকার কুমির হয়েছেন ডিপিডিসির এই কর্মকর্তা।



অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহর গ্রামের বাড়িতে টিনের ঘরে মা হামিদা খাতুনের বসবাস। দুদক থেকে রক্ষা পেতেই ভিন্ন এক কৌশল নিয়েছে তিনি। স্থানীয়রা জানান, ডিপিডিসির ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহ খুব এক বাড়িতে আসেন না। চাকরির সুবাদে তিনি পরিবার নিয়ে ঢাকাতেই থাকেন। নিজ নামে এলাকায় বিঘা বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। আর এই সব জমি দেখভাল করেন তার ভাগিনা আবুল বাশার। তার শ্বশুরবাড়ি একই জেলার ধনবাড়ী উপজেলার ভাইঘাটের পালপাড়ায়ও তার বিপুল পরিমান সম্পদে খোঁজ মিলেছে। ক্রয় করেছেন শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনদের নামে। যাতে সহজেই কেউ বুঝতে না পারেন এই সম্পদের মালিক  ডিপিডিসির এই কর্মকর্তা। তিনি যা আয় করেন সব টাকায় পাচাঁর করেন জাপানে। সেই টাকায় জাপান শহরে আলিশান জীবন-যাজন করছেন ছেলে তাসিন। একই জায়গায় থাকেন তার শ্যালক। এদের নামে হুন্ডি মাধ্যমে টাকা পাঁচার করেন জাপানে। সোমবার (৮ জুলাই) দুদকের উপপরিচালক সেলিনা আখতার বাদী হয়ে ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ দুটি মামলা করেন। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।


ছোট ভাই স্কুলশিক্ষক শহিদুল্লাহ বলেন, ভাই(হুজ্জাত) ঢাকায় চাকরি করেন। বাড়িতে খুব একটা আসেন না। তার ছেলে তাসিন থাকেন জাপানে। আর তিনি থাকেন রামপুরা বনশ্রী নিজ বাড়িতে।  হুজ্জাতের বড় ভাই হাবিবুল্লাহ বলেন, গ্রামের বাড়িতে আসেন না হুজ্জাত। ঢাকায় থাকেন স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে। ছেলে থাকে জাপানে। ভালোই আছে। কত সম্পদ আছে তা জানি না। ভাগিনা আবুল বাশার বলেন, মামা এর আগেও দুদকের মামলা খেয়েছিলো। অনেক টাকা খচর করে মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এবারও কিছু টাকা খচর হবে। দুদকের মামলা টাকা দিলে শেষ। তাই মামা একটু ঝামেলার মধ্যে আছেন। 


দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়,হুজ্জাত উল্লাহর দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, মো.হুজ্জাত উল্লাহর নিজ এবং স্ত্রীর নামে ২ কোটি ২ লাখ ২৫ হাজার ৯৮১ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৯০ টাকার অস্থাবর সম্পদ বাদ দিলে তার নামে ১ কোটি ৯০ লাখ ৬৮ হাজার ৯১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেন। 


অন্যদিকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে মো.হুজ্জাত উল্লাহ নিজ নামে স্থাবর অস্থাবর খাতে মোট ১ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার ৭০৫ টাকার জ্ঞাত আয়বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(২), ২৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রায় ৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩০ জুন দুদকের প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। যার স্মারক নং ০০.০১.০০০০.৫০৫.০৩.০০১.২১.২৩৬৪৮। হুজ্জাত উল্যাহ  ডিপিডিসি’র ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নামে ফ্ল্যাট নং-২০১ (ফার্স্ট ফ্লোর), হাউজ নং-১৬, রোড নং-৫, ব্লক-সি, বনশ্রী প্রজেক্ট, রামপুরা, ঢাকা ও টাঙ্গাইলের বেতবাড়ি গ্রামে তার নামে-বেনামে বিপুল পরিমান সম্পদের পাহাড় রয়েছে। ডিপিডিসির কর্মকর্তা হুজ্জাত উল্লাহর টাকায় তার স্ত্রী মিসেস মাহমুদা খাতুনের নামে ২০১১/২০১২সালে ফ্ল্যাট এবং প্লট মূল্য ক্রয় করেন।  যার মূল্য দেখিয়েছেন ২৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজার অনুযায়ী ওই সব সম্পদের মূল্য ৪ কোটি টাকার বেশি। দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে দেখানো হয়েছে  স্ত্রী মিসেস মাহমুদা খাতুনের নামে লেকসিটি কনকর্ড এ ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ফ্ল্যাট মূল্য দেখানো হয়েছে। যার মূল্য কোটি টাকার বেশি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রকল্পে প্লটের মূল্য ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। যার বর্তমান মূল্য তিন কোটি টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ওই কর্মকর্তার আয়কর নথীতে এই সম্পদের কোনো তথ্য উল্লেখ ছিলো না। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছে  ১১ লাখ ৫৭ হাজার ৮’শ ৯০ টাকা। কিন্তু বাজার অনুযায়ী সম্পদের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি। হুজ্জাত উল্লাহর ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের আয়কর নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পারিবারিক খরচ বাদে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৫১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯৪ টাকা। হুজ্জাত উল্লাহর তার বেতন ভাতা থেকে পারিবারিক ব্যয় বাদে বেতন কৃষি ও অন্যান্য আয় বাবদ ৮৩ লাখ ১২ হাজার ৯৩ টাকা আয় দেখালে দুদকের তদন্তে তা গরমিল পাওয়া গেছে।  


এ ব্যাপারে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক হুজ্জাত উল্লাহ’র সেল ফোনে কল দিলে রিসিপ করেননি। এমনকি ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি। 


জেবি/এসবি