পর্যটকশূন্য সিলেটে ক্ষতি পনেরো হাজার কোটি টাকা
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪:২৯ অপরাহ্ন, ২৭শে জুলাই ২০২৪
পর্যটনের নগর সিলেটে এখন পর্যটক নেই। খা খা করছে পর্যটন স্পটগুলো। নিরব নিস্তব্ধ জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি, শ্রীমঙ্গলের অগণিত চা বাগান থেকে শুরু করে প্রতিটি এলাকা। আর পর্যটক খরায় মাথায় হাত পর্যটন ব্যবসায়ীদের। প্রথমে চার দফা বন্যা, এরপর আন্দোলন ও পরে কারফিউ। এ তিন কারণে সিলেট যেন এখন এক নিস্তব্ধ জাহাজের নাম। স্থবির হয়ে পড়েছে সবকিছু। গত তিন মাস ধরে সিলেটে দেখা মেলেনি পর্যটকের। চলতি মাসের অর্ধেক দিন দোকানপাট খুলতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ঈদুল আজহাসহ পর্যটনের এই ভরা মৌসুমে সিলেট বিভাগে পর্যটনখাতেই ক্ষতি হয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা। চলমান পরিস্থিতিতে মাস শেষে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তায়। সিলেটের পর্যটনশিল্প রক্ষায় বিকল্প হিসেবে সরকারি প্রণোদনা চান ব্যবসায়ীরা।
পর্যটনশিল্পকে ঘিরে সিলেট মহানগর ও জেলা, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ চার জেলায় গড়ে ওঠেছে কয়েকশ হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউস। এই খাতে বিনিয়োগ কয়েক হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সিলেটের রেস্টুরেন্ট, রেন্ট-এ-কার, কুটিরশিল্প ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত পর্যটনশিল্প। পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লাখো মানুষের জীবন জীবিকার চাকা ঘুরে। কেউ নৌকা দিয়ে পর্যটক পরিবহন করে, আবার কেউ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু গত মে মাস থেকে সিলেটে শুরু হয় বন্যা। চার দফা বন্যায় বার বার বন্ধ ঘোষণা করা হয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো। নদীতে পানি ও স্রোত বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার কারণে পর্যটকরা সিলেটবিমুখ হয়ে পড়েন। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ায় চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সিলেটে পর্যটকরা আসতে শুরু করেন। যখনই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করেন পর্যটনখাতের ব্যবসায়ীরা, তখনই হোঁচট। স্বপ্ন মিলিয়ে গেলো কোটা সংস্কার আন্দোলনে। দেশজুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরে সংঘাত-সংঘর্ষ ও কারফিউয়ের কারণে পর্যটনখাতের ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পিছিয়ে পড়া সিলেটকে এগিয়ে নিতে হবে: সিসিক মেয়র
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে সারা দেশে পর্যটন ব্যবসা কমলেও সিলেটে পর্যটক আগমন হয় সবেচেয়ে বেশি। বর্ষায় প্রকৃতি নবযৌবন লাভ করে, এতে সৌন্দর্য বাড়ে, প্রকৃতিনির্ভর সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর। ফলে ওই সময় সারা দেশের পর্যটকদের ঝোঁক থাকে সিলেটে। কিন্তু এবার বন্যা ও কোটা আন্দোলনে পর্যটকদের দেখা মেলেনি সিলেটে। এমনকি বন্যার কারণে ঈদুল আজহায়ও সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। ফলে গেল তিন মাস ধরে সিলেটের বেশিরভাগ হোটেল পর্যটকশূন্য রয়েছে।
সিলেট বাংলা ট্যুর এন্ড ট্যুরিজমের স্বত্তাধিকারী ও সিলেট চেম্বারের পর্যটন সাব কমিটির আহবায়ক হুমায়ুন কবীর লিটন বলেন, সিলেটের পর্যটন এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দফায় দফায় বন্যা, আন্দোলন আর সর্বশেষ কারফিউসহ একের পর এক দুর্যোগ। অনেক পর্যটন ব্যবসায়ীরা ভূর্তুকী দিয়ে চলেছেন গত তিন মাস ধরে। কথায় আছে বসে খেলে ‘রাজার রাজ্যও শেষ হয়ে যায়’। এই অবস্থা হয়েছে সিলেটের পর্যটন ব্যবসায়ীদের। ভরা মওসুমে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুর্যোগ। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনার কোন বিকল্প নেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও কারফিউ বলবৎ থাকায় শ্রীমঙ্গল প্রায় পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। এতে লোকসানে পড়েছেন স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
আরও পড়ুন: বন্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে মৌলভীবাজারে মানববন্ধন
শ্রীমঙ্গল চায়ের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এখানকার সারি সারি চা-বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য ও দশর্নীয় স্থান মুগ্ধ করে পর্যটকদের। তাই সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর শ্রীমঙ্গলে কমতে শুরু করেছিল পর্যটকের সংখ্যা। গত প্রায় ১০ দিনে নতুন করে কোনো পর্যটক আসেননি। আগে যেসব পর্যটক এসেছিলেন তাঁরা ফিরে গেছেন। এখন শ্রীমঙ্গলে পর্যটক নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের শ্রীমঙ্গল শাখার সাধারণ সম্পাদক রাসেল আলম বলেন, দেশের পর্যটকদের পাশাপাশি অনেক বিদেশি পর্যটক বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতি কথা বিদেশি পর্যটকেরা জানতে পেরেছেন। দূতাবাস থেকে স্ব স্ব দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ জন্য বিদেশি পর্যটকেরা ঘুরতে বের হচ্ছেন না। বিদেশ থেকেও কেউ আসছেন না। রাসেল আলম আরও বলেন, ‘বিদেশি পর্যটকেরা যখন দেশের বাইরে যান, তখন প্রায় তিন-চার মাস আগেই পরিকল্পনা শুরু করেন। আমাদের দেশে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বিদেশি অনেক পর্যটকই বাংলাদেশের আসার পরিকল্পনা বাতিল করতে পারেন। শীতের শুরু অর্থাৎ অক্টোবরে দেশি–বিদেশি পর্যটকেরা ঘুরতে বের হন। আর মাত্র কয়েকটি মাস বাকি। পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে যাবে। দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
পর্যটক কমে যাওয়ায় লোকসানের মুখে আছে অনেক রেস্তোরাঁ। চামুং রেস্টুরেন্টের মালিক তাপস দাশ বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলের অনেক রেস্তোরাঁ পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে। গত ১০ দিন রেস্টুরেন্ট মালিকেরা লোকসানে আছি। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পর্যটকেরা শ্রীমঙ্গল না আসায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
আরও পড়ুন: আবারও সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাবেক সভাপতি ও গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্টের মালিক সেলিম আহমেদ বলেন, ‘গত কয়েক দিন পর্যটক নেই। সব হোটেল রিসোর্ট প্রায় ফাঁকা। দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দূরপাল্লার গাড়ি সঠিক সময়ে না চলা, ট্রেন বন্ধ থাকা ও কারফিউ জারি থাকায় পর্যটকেরা আসছেন না। অনেকে এই পরিস্থিতিতে নিজস্ব গাড়ি বের করতে বা পরিবার নিয়ে ঘুরতে সাহস পাচ্ছেন না।’
সেলিম আহমেদ জানান, অনেকে ফেসবুকে প্রচারণা ও মার্কেটিং করেন। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না থাকায় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। এ ভাবে চললে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাহমিন আহমদ বলেন, সিলেটবাসীর ভাগ্য খুব খারাপ। ২০২০-২১ সাল গেল করোনায়। স্থবির হয়ে যায় সবকিছু। ২৩ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর একটু চেষ্টা ছিল, কিন্তু ২০২৪ সালের দফায় দফায় বন্যা ও আন্দোলনে সব শেষ হয়ে গেছে। ঈদের পর থেকে সিলেটের পর্যটন খাতের ব্যবসা খুবই কঠিন সময় পার করছে। বন্যা ও আন্দোলনের কারণে সিলেট বিভাগে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন।
এমএল/