মানববন্ধনে আসতে বাধার মুখে কুবি শিক্ষকরা, শেষে দাঁড়ালো ৬ জন


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৭:১৩ অপরাহ্ন, ১লা আগস্ট ২০২৪


মানববন্ধনে আসতে বাধার মুখে কুবি শিক্ষকরা, শেষে দাঁড়ালো ৬ জন
ছবি: প্রতিনিধি

দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের হত্যা, নিপীড়ন ও হয়রানির প্রতিবাদে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মানববন্ধনে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসতে চাইলে সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত স্থানীয় লোকজনের বাধার সম্মুখীন হন তারা। ফলে ছয় জন শিক্ষক নিয়ে মানববন্ধন করেছে কুবির শিক্ষকরা।


শিক্ষকদের প্রবেশে বাধা দেয়ার ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হল ভূঁইয়া বলেন, ‘কর্মসূচিটি সকাল ১১ টায় করার কথা থাকলেও আমরা করতে পারিনি। আমাদের অনেক সহকর্মীকে আটকে দেওয়া হয়েছে কোটবাড়ি। তারা শিক্ষক পরিচয় দিয়েও তাদের কর্মস্থলে আসতে পারেননি। প্রক্টরকে জানানো হলেও আসতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? তারা কারা? তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে কেন আসতে পারবেন না? আমরা কোন ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার দায়িত্ব জড়িত, আমার কাজ জড়িত, আমার ইমোশন জড়িত, আমার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমরা কেন আসতে পারবো না?’


আরও পড়ুন: কুবিতে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কে মারধরের প্রতিবাদে মানববন্ধন


বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) সকাল ১১ টা ৫৬ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী এম. আনিছুল ইসলামের সঞ্চালনায় এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।


মানববন্ধনে উপস্থিত ছয় জন শিক্ষক হলেন- বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন নাহার শিলা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষক জয় রাজ বংশী, বাংলা বিভাগের প্রভাষক গোলাম মাহমুদ পাভেল।


মানববন্ধনে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন বলেন,  আমরা আজকে সবাই এখানে দাড়িয়েছি একটা বিচারহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য। শুধুমাত্র নিজের মৌলিক অধিকার চাইতে গিয়ে যেভাবে শতশত শিক্ষার্থী, সাধারণ জনগণ সেখানে শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবক তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে সেটা গণহত্যা। এই গণহত্যার মধ্যে দিয়ে যা করা হয়েছে সেটি একবারে নিজের যে ক্ষমতা সেটির চর্চা। যেটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। আমি এই নির্মম  গণহত্যার বিচার চাই এবং তীব্র প্রতিবাদ করছি।’


তিনি আরো বলেন, ‘এখন আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন আমি কার কাছে বিচার চাচ্ছি।  আমি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিচার চাই না। কারণ এই যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এটার সাথে রাষ্ট্র প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আছে। আমি বিচারিকের কাছেও বিচার চাইতে যাবো না। আমি বিচার চাই আমার দেশের সাধারণ জনগণের কাছে, তারা দেখেছেন, তারা দেখছেন, দেখবেন এবং অবশ্যই তারা  এর বিচার করবেন। কারণ আমরা জানি, জনগণের বাণীই ইশ্বরের বাণী এবং আপনি যদি ক্ষমতাকে ইশ্বর মনে করে থাকেন তাহলে সেটা হবে  চরম ভুল, যা এখন হচ্ছে তা সামনেও হবে। এই অরাজকতা, এই বিচারবিহীন রাজনীতি এবং হত্যাযজ্ঞের বিপরীতে আমাদের দাড়াতে হবে হয়ত আমাদের ক্ষতি হতে পারে কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। আমরা সকলে দাড়াবো একে একে দাড়াবো, দুইয়ে দুইয়ে দাড়াবো, দশে দশে দাড়াবো।


আরও পড়ুন: পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষে উত্তপ্ত কুবি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ


বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গত ১৮ জুলাই কোটবাড়ী বিশ্বরোডে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়া তার সন্তান সারাফ সামির জামান মেঘের মা ড. কামরুন নাহার শিলা  বলেন, ‘আমার সন্তানও আহত হয়েছে আমি সেই কারনে আসিনি। শুরু থেকেই সাধারণ মানুষের উপর যে নিপীড়ন শিক্ষার্থীদের হত্যা এই বিষয়ে সকল শিক্ষকদের মত আমিও মর্মাহত ছিলাম। আমাদের আরো আগেই নামা উচিত ছিলো। আমরা আসলে লজ্জিত। আমার নিজের জীবনে যেহেতু একটা দুর্বিপাক ঘটে গেছে এর কারনে আমি আগে পদক্ষেপ নিতে পারিনি। আমার ছেলে আহত হয়েছে। আমার ছেলে মারাও যেতে পারতো। সেদিন বুঝতে পেরেছি এতো এতো শিক্ষার্থীদের পরিবার কি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে! আমার ছেলে ছোট তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে। আমরা দেখেছি নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর কীভাবে টার্গেট করে গুলি করা হয়েছে। এই যে একটা নৈরাজ্য অবস্থা তৈরী হয়েছে তার দ্রুত নিরসন চাই আমরা।’


মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রবেশে আটকে দেয়ার ব্যাপারে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হল ভূঁইয়া বলেন, ‘কর্মসূচিটি সকাল ১১ টায় করার কথা থাকলেও আমরা করতে পারিনি। আমাদের অনেক সহকর্মীকে আটকে দেওয়া হয়েছে কোটবাড়ি। তারা শিক্ষক পরিচয় দিয়েও তাদের কর্মস্থলে আসতে পারেননি। প্রক্টরকে জানানো হলেও আসতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? তারা কারা? তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে কেন আসতে পারবেন না? আমরা কোন ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের ক্যাম্পাসে আসতে পারবেন না? আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার দায়িত্ব জড়িত, আমার কাজ জড়িত, আমার ইমোশন জড়িত, আমার শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমরা কেন আসতে পারবো না?’


সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,  পলিটেকনিক মোড়, ক্যাডেট কলেজ মোড় ও আনসার ক্যাম্পের সামনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সব ধরনের যানবাহন চেক করছেন। যারাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিমুখে  যেতে চাইছেন তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র, শটগান সহ নানা অস্ত্র দেখা যায়। ছাত্রলীগ, যুবলীগের বাধার মুখে পড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হলেন- গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম, অধ্যাপক খলিফা মোহাম্মদ হেলাল, আনোয়ার হোসেন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম মনিরুজ্জামান।


আরও পড়ুন: ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে কুবি শিক্ষার্থীরা


আনসার ক্যাম্পের মোড়ে সদর  উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এড.আমিনুল ইসলাম টুটুল নেতাকর্মীদের নিয়ে অবস্থান করছেন।  ক্যাডেট কলেজ মোড়ে গিয়ে দেখা যায় সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান  আহমেদ নিয়াজ পাবেল নেতাকর্মীদের দাঁড়িয়ে আছেন। মুঠোফোনে আহমেদ নিয়াজ পাবেল জানান, ‘কোন শিক্ষককে তাঁরা  ফিরিয়ে দেননি। জামায়াত-বিএনপি যেন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য তাঁরা মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন।


এ ব্যাপারে গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল হাকিম বলেন,‘আমরা কোটবাড়িতে আসার পর কয়েকজন মানুষ আমাদের পথরোধ করে। আমরা শিক্ষক পরিচয় দিলেও নমনীয় হয়নি। আমাদেরকে শহরের দিকে চলে যেতে বলে’

আমাদের চলে যেতে বলার তারা কারা বা কোন পরিচয়ে তারা এই কথা বলছেন জিগ্যেস করলে তারা কোন পরিচয় দেয়নি। আমরা প্রক্টরকে জানিয়েছি, রেজিস্টারকে জানিয়েছি। দীর্ঘ এক ঘন্টা অপেক্ষা করেও কোন পুলিশ বা কারো থেকে কোন সাহায্য আসেনি। আমাদেরকে বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।


কুমিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) ড. কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন,  ‘একজন শিক্ষক জানিয়েছিলেন যে উনি আসতে পারছিলেন না। সাথে সাথে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি। প্রক্টরিয়াল বডির দায়িত্ব ক্যাম্পাসের ভিতরে। বাইরে যদি কোন ঘটনা ঘটে সেটার জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করতে হয়। সেটা আমরা করেছি।’


আরও পড়ুন: প্রায় তিন ঘন্টা পর মহাসড়ক ছাড়লো কুবি শিক্ষার্থীরা


সদর দক্ষিন থানার অফিসার্স ইনচার্জ আলমগীর ভূইয়া বলেন, সরকার দলীয় লোকেরা শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আসতা বাধা দিচ্ছে এই ব্যাপারে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি একটু আগে ঘুরে আসলাম এমন কিছু লক্ষ্য করি নাই'


এসডি/