মুক্তিযোদ্ধা-বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে অবসরের ঘোষণা ওসির
জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭:১৫ অপরাহ্ন, ১৩ই আগস্ট ২০২৪
সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে স্বেচ্ছায় অবসরের ঘোষণা দিলেন পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম ছরোয়ার।
রবিবার (১১ আগষ্ট) তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে এ ঘোষণা দেন। ফেসবুক স্ট্যাটাসে ওসি মো. গোলাম ছরোয়ার লেখেন, ‘বিদায় বাংলাদেশ পুলিশ’ বিদায়বেলা কিছু কথা। আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। আমার মা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন। তখন আমার জন্ম হয়নি। বড় হওয়ার সাথে সাথে জানতে পেরেছি তৎকালীন সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ থাকায় আমার মায়ের পরামর্শে তিনি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। এসে তিনি স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন এবং একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
এরপর ধীরে ধীরে তিনি পেশা হিসেবে ব্যবসাকে বেছে নেন। বাউফল উপজেলার বাহেরচর বন্দরে আমাদের একটি আড়ত, একটি রাইস মিল ও একটি ফার্মেসি ছিল। বেড়ে ওঠা কালীন আমার বাবাকে মাঝে মধ্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর লোকজন খুজতে আসতো, কিন্তু কেন আসতো তা আমরা জানতাম না। বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে আমার বাবাকে খোঁজা হতো। পুলিশের জন্য আমার বাবা বাড়ি থাকতে না পেরে বিভিন্ন শহরে এসে ক্যানভাচারের কাজ করতো জীবিকা নির্বাহের জন্য। এভাবে আত্মগোপনে থেকে তাকে অনেকদিন পার করতে হয়েছে। একবার আমাদের স্বনামধন্য এমপি আ স ম ফিরোজ মহোদয় নৌকা মার্কা না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন।
আরও পড়ুন: দেশব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতন, বাড়িঘরে হামলার প্রতিবাদে কলাপাড়ায় মানববন্ধন
কিন্তু আমার বাবা নৌকার বিপক্ষে না যেয়ে নৌকা মার্কায় অবিচল থেকে কাজ করেন, কার পক্ষে কাজ করেছেন তাকে আমরা চিনিও না তেমন। নীতিগত কারণে তিনি নৌকা মার্কার প্রার্থীর প্রতি অবিচল ছিলেন। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত নৌকা মার্কা হেরে গেল। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হলেন এবং পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদান করলেন। এরপর আমাদের পরিবারের অবস্থা বিরোধীদলের চেয়েও খারাপ ছিল। আমার বাবা পুরাদমে ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই থেকে আমাদের পরিবার সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে আছি। এরপর বেশ ভালোই ছিলাম। হঠাৎ একদিন (বিএনপি ঘরানার) আমাদের বাড়ির এক মেয়ে আমার বড় ভাইকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজ দায়িত্বে আমাদের ঘরে চলে আসেন। আমার ভাই তখন বরিশালে ছিল। নানাভাবে মেয়েকে বুঝালাম পরিবারের সাথে কথা বললাম ফিরে যাওয়ার জন্য কিন্তু তিনি অনঢ় ছিলেন তিনি যাবেন না। এলাকার সব লোক মিলে বুঝিয়েও তাকে ফেরাতে পারেন নাই।
হঠাৎ রাতের বেলা পুলিশ আসলো, আমার বাবা-মাকে গ্রেফতার করল এবং থানায় নিয়ে মামলা দিয়ে চালান দিল। বলল আমরা নাকি ওই মেয়েকে অপহরণ করেছি। আসলে কী আইনে কী অপরাধ ছিল সেটাই আমরা জানতাম না, পরে শুনেছি নারী নির্যাতনের নতুন আইন হয়েছে। যাই হোক অনেক কিছুর পরেও সেই মেয়েকে নিয়েই আমর বড় ভাই এখনো সংসার করছেন। আমার বাবা-মায়ের জন্য এর চেয়ে বড় অপমান আর কিছু ছিল না। পুলিশ তো জানতো কোনটা সত্যি ছিল, কোনটা মিথ্যা ছিল। ছেলের সুখের জন্য আমার বাবা-মা সব কিছু মেনে নিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অপমানের কথা ভুলতে পারলেন না। এরপরও অনেক পুলিশ হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। কারণ আমাদের পেছনে কোনো শক্তি ছিল না। বাবা আমাকে বলেছিলেন যাই হোক কখনো কোন মানুষের ক্ষতি করবে না। সেই নীতিতেই বেঁচে আছি এবং পথ চলছি। আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তালিকাভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কারোর দয়ায় বা করুণায় নয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার কোটায় আমার চাকরি হয়েছে। যেভাবে সোমবার (৫ আগস্ট) দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো, যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্যসহ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে অপমান করা হলো, ভেঙেচুরে চুরমার করা হলো সেখানে কোনো নৈতিক অধিকারে আমি এ চাকরি করি। চাকরিকালীন আমি সব কর্মস্থলেই নিরপেক্ষতার সাথে কাজ করতে পেরেছি, তবে রাজনৈতিক কারণে কিছু কাজ করতে হয়েছে।
যেহেতু আমি সরকারি চাকরি করি। আমি জীবনে কখনো কোনো তদবির করি নাই, যেখানে দায়িত্বে দিয়েছে সেখানেই দায়িত্ব পালন করেছি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস আমাদের শেষ হয়েছে। এখন হয়তো নতুন স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস শুরু হবে। আমি নতুন প্রজন্মের কাছে আমার মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় থাকা চাকরিটি ছেড়ে দিলাম, তাড়া নতুন উদ্যমে জায়গা পূরণ করে নেবেন এবং প্রত্যাশিতভাবে দেশকে সাজাবেন এ অনুরোধ রাখলাম। আমি আমার বাবার দেখানো নীতিতেই বাকিটা পথ হাঁটবো। বাবা বলেছিলেন- যেখানে সম্মান নেই সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও।
আরও পড়ুন: বাকেরগঞ্জে ধসে পড়ছে সেতু, যান চলাচল বন্ধ
সাধারণ জনগণের কাছে পুলিশ যেভাবে অসম্মানিত হল, সেই ইমেজ নিয়ে কীভাবে জনগণকে সেবা করব। আমি আমার বাবার সম্মান রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে বিদায় জানালাম। আমি স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়ে দিলাম। তবে আইন পেশার সাথেই যুক্ত থাকবো। সকলের জন্য শুভকামনা রইল। আমিন। জয় বাংলা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।’
এ ব্যাপারে স্বরূপকাঠি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. গোলাম ছরোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি। তবে এ বিষয়ে তার কাছ থেকে এখনো কোনো লিখিত কাগজ পাইনি।
এমএল/