কুবিতে অজস্র স্থাপনার ভিড়ে জায়গা হচ্ছে না মন্দির নির্মাণের !


Janobani

ক্যাম্পাস প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১২:১৯ অপরাহ্ন, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৪


কুবিতে অজস্র স্থাপনার ভিড়ে জায়গা হচ্ছে না মন্দির নির্মাণের !
ছবি: জনবাণী

প্রসেনজিত দাস: দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই প্রতিদিনের মতো করে ক্যাম্পাসে হাঁটতে বের হলাম। আকাশটাও মেঘলা ছিলো। ক্যাফেটেরিয়া পার করে একটু সামনে এগোতেই দেখলাম মুক্তমঞ্চের খোলা জায়গাটায় ২০-২৫ জন সনাতনী একসাথে বসে সাপ্তাহিক প্রার্থনায় রত। প্রত্যেকের মাঝেই ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতা লক্ষ করার মতো ছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো সৃষ্টিকর্তার প্রতি আঁত্মাকে সঁপে দিতে পারলেই কেবল রাজ্যের সুখ প্রাপ্তি ঘটে। প্রার্থনা চলাকালীন একপর্যায়ে সনাতন ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র মন্ত্র ‘গায়ত্রী’ পাঠ যখনই শুরু হলো হঠাৎই আকাশ ফেটে বৃষ্টি। শুরু হলো সমগ্র প্রার্থনা সামগ্রী গুটিয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার তড়িঘড়ি। একজন তো দ্রুত যাওয়ার চেষ্টায় পিচ্ছিল খেয়ে পড়েই গেলো। কথা বলে জানা গেলো বৃষ্টির কারণে আজকের মতো তাদের প্রার্থনা স্থগিত।


এভাবেই চলছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দীর্ঘ ১৮ বছরের প্রার্থনা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের আবেদন মন্দির বা উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। মন্দিরের বদৌলতে অন্তত একটি প্রার্থনা কক্ষের বরাদ্দে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈনের আশ্বাস মিললেও সেটি বাস্তবায়নে ছিলো প্রশাসনের নিরব ভূমিকা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার বলছে নির্মাণাধীন নতুন ক্যাম্পাসে মন্দির থাকবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বলছে, ‘কবে নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হবে, তারপর মন্দির; সেই আশায় তাহলে এখন আমরা ধর্মীয় চর্চা বন্ধ রাখবো? নিজেদের অস্তিত্বকে দমিয়ে রাখবো?’


বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রায় সকল পদে রয়েছে শূন্যতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক গতকাল রবিবার (২ সেপ্টেম্বর) সকল ডিন এবং অধ্যাপকদের মধ্যকার আলোচনাসভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগপূর্বক সকল প্রশাসনিক এবং আর্থিক দায়িত্বসহ চলমান গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সকলকার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জাকির ছায়াদউল্লাহ খানকে।


আরও পড়ুন: আবারও হলে উঠে আধিপত্য বিস্তার করতে চাই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ


এমতাবস্থায় গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা ধর্মচর্চার জন্য মন্দির বা প্রার্থনাকক্ষ নির্মাণ এবং নির্মাণ না হওয়া অবধি আগামী ১৪ দিনের একটি অস্থায়ী প্রার্থনা কক্ষের দাবি নিয়ে রেজিস্ট্রারের কাছ চিঠি দিয়েছে। রেজিস্ট্রার মো. মুজিবুর রহমান মজুমদার বিষয়টি নিশ্চিত করেছন।


তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা বলেছে পূর্ববর্তী প্রশাসনের কাছে একাধিকবার মন্দিরে দাবি তুলেছে, কিন্তু কেন এখনো এটি কার্যকর হয়নি সেটা বলতে পারছি না। এই বিষয়ে এখন আমার কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার নেই। নতুন উপাচার্য নিয়োগ হলে আমি উনার কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করবো। সনাতনীদের দাবিটি যৌক্তিক, নতুন উপাচার্য যাতে ইতিবাচক সাড়া দেই, বিষয়টি সেভাবেই উনার কাছে উপস্থাপন করবো।’


সনাতন শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ক্যাম্পাসে প্রার্থনা বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে অমাবস্যার চাঁদের মতো। এইবুঝি চাঁদ উঁকি দিলো তো এই গায়েব। বছরের পর বছর প্রার্থনা চলছে কখনো মুক্ত মঞ্চে, ক্যাফেটেরিয়ার ছাঁদে, কখনো ব্যাডমিন্টন কোর্টে। দেখে মনে হতে পারে যেন যাযাবরীয় সংস্কৃতি। কোন নির্দিষ্ট সংকল্প ছাড়া যখন যেখানে খুশি যা ইচ্ছে করছে। এভাবে আসলে একটা ধর্ম চলতে পারে না। আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অজস্র স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, শুধু আমাদের মন্দির স্থাপনের জন্য এক টুকরো জায়গার ব্যবস্থা হচ্ছে না।


এনিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ২০১৯-২০ বর্ষের শিক্ষার্থী সৌরভ বিশ্বাস জানান, ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে, তবে দুঃখজনকভাবে এখনও মন্দির বা প্রার্থনা কক্ষের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা ইতোমধ্যে চার বার আবেদন করেছি, তবু এখনো মন্দির নির্মাণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই, অবিলম্বে মন্দির নির্মাণের কাজ হাতে নিতে হবে এবং মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে একটি অস্থায়ী প্রার্থনা কক্ষ প্রদান করতে হবে। অন্যথায়, আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।’


গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের শিক্ষার্থী জয় রায় অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের জন্য মুক্ত ধর্মচর্চার সুয়োগ থাকবে এটাই অনুমেয়। কিন্তু এখানে আর সেই সুযোগটা পেলাম কোথায়? দেশ যেখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, কিন্তু এখানে তার উল্টোটা। মন্দির কবে হবে জানি না, আমরা অস্থায়ী একটা প্রার্থনা কক্ষের জন্যে বারবার ভিসি স্যারের কাছে গিয়েছি। সেটারও সমাধান হয়নি। এদিকে বৈরী আবহাওয়া দেখা দিলেই সবকিছু ভন্ডুল। যেখানে ধর্মচর্চারই সুযোগ নেই, সেখানে অস্তিত্ব সংকটে ভোগছি, এটাই নিয়তি।’


পরিসংখ্যান বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষের জয়া ভৌমিক বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার জন্য যখন মন্দিরে যাই তখন মনের মধ্যে একটা পবিত্রতা কাজ করেছিল। ঠিক তেমনই দেশের প্রায় প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মন্দির রয়েছে কিন্তু আক্ষেপ আমাদের এখানে কোন মন্দির নেই। প্রশাসনের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া আমাদের ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার জন্য একটা নির্দিষ্ট স্থান প্রয়োজন। তাই শীঘ্রই মন্দিরের জন্য এই অপেক্ষার শেষ হোক।’


এছাড়াও সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে সরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, দীপাবলি, রাধাষ্টমী, হোলি উৎসবসহ প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক প্রার্থনায় বসে সেখানে ধর্মচক্র, কীর্তন-করা, ঈশ্বরনাম জপ করা, ধর্মীয় আচার গুলো আলোচনা করা ইত্যাদি করে থাকেন।


আরও পড়ুন: নোবিপ্রবিতে নিষিদ্ধ হলো ছাত্র রাজনীতি


বিশ্ববিদ্যালয়ের পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য মোতাবেক, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী প্রায় ৬ শত, শিক্ষক প্রায় ৩০ জন এবং এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। প্রতিবছরই এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে।


পূজা উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুব্রত সরকার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সনাতনীদের সকল কার্যক্রম পূজা উদযাপন পরিষদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ দাবির পরেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য এখনো পর্যন্ত একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়নাই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি প্রতিদিন সন্ধ্যায় পূজো হচ্ছে, প্রার্থনা হচ্ছে কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগটা কখনোই পাইনি। আমি আশা করছি, প্রশাসন এই ব্যাপারে উদ্যোগ নিবে এবং মন্দির না হওয়া পর্যন্ত ধর্মীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি অস্থায়ী রুমের ব্যবস্থা করে দিবে।’


এই বিষয়ে বর্তমানে উপাচার্য নিয়োগপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. জাকির ছায়াদউল্লাহ বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে কোন নীতিগত সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই বা দেওয়া হয়নি। আমাকে কিছু সিলেক্টেড বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সনাতনীদের এই দাবির পক্ষে। এবিষয়ে আমি সনাতনী কয়েকজন শিক্ষকের সাথে আলোচনা করে বিষয়টি এগিয়ে রাখবো, যেন পরবর্তী উপাচার্য আসলে মন্দিরের কাজটি সহজ হয়ে যায়।’


আরএক্স/