আইন সচিবের পদত্যাগের দাবিতে সংক্ষুব্ধ রেজিস্ট্রেশন অঙ্গন, আইন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে সমাধান


Janobani

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪:৫৫ অপরাহ্ন, ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০২৪


আইন সচিবের পদত্যাগের দাবিতে সংক্ষুব্ধ রেজিস্ট্রেশন অঙ্গন, আইন উপদেষ্টার হস্তক্ষেপে সমাধান
ফাইল ছবি

দেশব্যাপী ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি প্রত্যহার করে ২৭ আগস্ট দুপুর থেকেই কাজে ফিরেছেন সাব-রেজিস্ট্রারগণ। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশের ৫০১ টি সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সব কটিতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু আছে।


২০০ বছরেরও অধিক পুরনো সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়সমূহের নিয়ন্ত্রণকারী অফিস হলো নিবন্ধন অধিদপ্তর। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর এর পরপরই দেশের ২য় সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠান হলো নিবন্ধন অধিদপ্তর যাদের সংগৃহীত রাজস্বের পরিমান বছরে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। অথচ ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানে নেই পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, নেই কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা, লোকবল সংকট চরমে, বেশিরভাগ জায়গায় নেই নিজস্ব ভবন, বালাম বইসহ আনুষাঙ্গিক দ্রব্যাদির জন্য হাহাকার আর বাড়তি ভোগান্তি হিসেবে আছে রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসে ব্যাপক বদলি বাণিজ্য। সবকিছু মিলিয়ে নাই এর তালিকা অনেক দীর্ঘ। যার ফলে প্রচুর মেধাবী ও তরুণ কর্মকর্তা থাকার পরেও জনমনে নিবন্ধন বিভাগ সম্পর্কে ধারণা অত্যন্ত নেতিবাচক। দেশে ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে এই বিভাগের তরুণ কর্মকর্তাগণ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় আশান্বিত হয়ে সেবা সহজীকরণ, বদলি বাণিজ্য বিলোপ এবং দুর্নীতি দূর করে সার্ভিসে স্বচ্ছতা আনয়নের জন্য প্রাচীন রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস উন্নয়ন ও সংস্কারে ১১ দফা সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে এবং গত ১৮ই আগস্ট থেকে মাননীয় আইন উপদেষ্টার সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে আসছিলো। কিন্তু আইনসচিব সহ স্বার্থান্বেশী মহল তাদের অতীত কুকর্ম ফাঁসের ভয়ে এ উদ্যোগে বাধা দিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। একই সাথে এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ২২শে আগস্ট একটি বৈষম্যমূলক চিঠি ইস্যু করে। কর্মকর্তা ও তাঁর পরিবারের সম্পদ বিবরণী চেয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের কর্মকর্তা এবং রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য ভিন্নতর ২ টি চিঠি ইস্যু করা হয়। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার (স্বামী, স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা) এবং রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তার (স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এবং পিতা ও মাতা) এর সম্পদ বিবরণী চেয়ে ভিন্নতর চিঠি ইস্যু করা হয়। ফলে পিতা-মাতার সম্পদ বিবরণী চেয়ে মন্ত্রণালয়ের এরূপ বিমাতাসুলভ ও বৈষম্যমূলক আচরণে আইন ও বিধিবহির্ভূত চিঠি ইস্যু করায় সাব-রেজিস্ট্রারদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ  সৃষ্টি হয়। ইতঃমধ্যে সাব-রেজিস্ট্রারগন নিবন্ধন অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে দেখা করার প্রচেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে ২৫ আগস্ট সরাসরি আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৬ এ গিয়ে নিজেদের ১১ দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং উপদেষ্টা মহোদয়ের সাথে দেখা করতে না দেওয়ার ঘটনার প্রতিবাদ জানান। এর পরপরই উক্ত স্বার্থান্বেশী মহল দ্রুততার সাথে বৈষম্যমূলক চিঠি সংশোধন করেন এবং এ প্রতিবাদের ঘটনাকে প্রেরিত চিঠির বিরুদ্ধে আন্দোলন আখ্যায়িত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করান। এর ফলে তরুণ সাব-রেজিস্ট্রারগণ যারপরনাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং বৈষম্যহীন, জনবান্ধব ও স্বচ্ছ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস গড়ার জন্য “বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের অপকর্ম, শোষণ-নির্যাতন, গুম, খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যার অন্যতম কুশীলব, বদলি বাণিজ্যের প্রধান হোতা আইন ও বিচার বিভাগের সচিব গোলাম সরওয়ার” সহ উপসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের অপসারণের দাবীতে ২৭ আগস্ট মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়।


উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৭ আগস্ট দুপুরে মাননীয় আইন উপদেষ্টা জনাব আসিফ নজরুলের সাথে রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অন্তর্বর্তীকালীন সংস্কার ও উন্নয়ন কমিটির একটি প্রতিনিধিদলসাক্ষাৎ করেন। পরিস্থিতি ব্যাখ্যাপূর্বক ১১ দফা দাবীর বিষয়ে মাননীয় উপদেষ্টা মহোদয়কে অবহিত করা হয়। তিনি সাগ্রহে সবকিছু বিস্তারিত শোনেন, দাবীসমুহকে ইতিবাচক মত দেন এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস প্রদান করেন। এর প্রেক্ষিতে সাব-রেজিস্ট্রারগণ কর্মবিরতি প্রত্যাহারপূর্বক ২৭ আগস্ট দুপুর থেকেই নিয়মিত কাজে যোগদান করেন।


আরও পড়ুন: নতুন কর্মসূচি দিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন



বর্তমানে দলিল রেজিস্ট্রেশনসহ সকল দাপ্তরিক কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চললেও সাব-রেজিস্ট্রারগন উপদেষ্টা মহোদয়ের আশ্বাসের দ্রুত বাস্তবায়ন ও এ বিভাগের সার্বিক কার্যক্রমের উপর তার বাস্তবিক প্রতিফলন আশা করেন।


সাব-রেজিস্ট্রারদের উত্থাপিত ১১ দফা দাবিগুলো হলো-


আরও পড়ুন: ঈদে মিলাদুন্নবী কবে, জানা যাবে সন্ধ্যায়


প্রস্তাবনা

রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সার্ভিস। এই সার্ভিসের সাথে দেশের গণ মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ভূমি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা স্থাপন, জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধ ও রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এই সার্ভিস যাত্রা শুরু করে। সম্পত্তি হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রেশন এবং রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের তথ্যাদি বা রেকর্ড সুরক্ষা করা রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসের অন্যতম কাজ। কালের পরিক্রমায় রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ, জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক বিপুল রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সূদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসের কাজের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দলিল রেজিস্ট্রেশন সেবা সহজীকরণ, দাপ্তরিক কাজে স্বচ্ছতা আনয়ন এবং সেবার মান বৃদ্ধিকল্পে রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস উন্নয়ন ও সংস্কারে আমরা ১১ দফা প্রস্তাবনা পেশ করছি:


১। সেবাদানে দায়িত্ব ও কর্মপরিধির গুরুত্ব এবং রাজস্ব আদায়ে অবদান বিবেচনায় রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসকে ক্যাডার সার্ভিসে উন্নীত করতে হবে।

২। মন্ত্রণালয়ে পৃথক "রেজিস্ট্রেশন বিভাগ" প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং স্বীয় বিভাগীয় অফিসারদের নিয়োগ করে মন্ত্রণালয়ে রেজিস্ট্রেশন সার্ভিসের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

৩। ৬ষ্ঠ গ্রেডে সিনিয়র সাব-রেজিস্ট্রার ও অতিরিক্ত জেলা রেজিস্ট্রার পদ সৃজন করতে হবে এবং জেলা রেজিস্ট্রার পদসহ ঊর্ধ্বতন সকল পদকে আপগ্রেড করে নিবন্ধন অধিদপ্তরের নূতন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হবে।

৪। কর্মকর্তা ও কর্মচারী বদলির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বদলি বাণিজ্য দূর করতে একটি কার্যকরী 'কর্মকর্তা এবং কর্মচারী বদলি নীতিমালা' প্রণয়নপূর্বক ইহা বাস্তবায়ন করতে হবে। বৈষম্যের শিকার হয়ে সাময়িক বরখাস্তকৃত ও সংযুক্ত কর্মকর্তাগণকে অবিলম্বে পদায়ন করিতে হইবে।

৫। অনলাইনে দলিল রেজিস্ট্রির জন্য জনস্বার্থে দলিল ই-রেজিস্ট্রেশন সেবা সারাদেশে অতি দ্রুত চালু করতে হবে। জনগুরুত্বপূর্ণ দলিলের বালাম বহির ডিজিটাল আর্কাইভ ও ডিজিটাল ইনডেক্স ডাটাবেজ এর ব্যবস্থা করিতে হইবে।

৬। রেজিস্ট্রারিং অফিসারের আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেবার মান বৃদ্ধি ও সেবা সহজীকরণে রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮ ও রেজিস্ট্রেশন বিধিমালা, ২০১৪ এবং সংশ্লিষ্ট কতিপয় আইন ও বিধিমালা সংশোধন করতে হবে।

৭। নিবন্ধন অধিদপ্তরের জন্য নিজস্ব ভবন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া জনবান্ধব সেবা নিশ্চিতকল্পে সারাদেশের পুরোনো ও জরাজীর্ণ জেলা রেজিস্ট্রার অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসমূহের জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ভবন নির্মাণ করতে হবে। যে সকল ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলোর নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। জেলা ও তদুর্ধ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি ও পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮। ভিজিট ও কমিশনে দলিল রেজিস্ট্রেশনের জন্য নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে এবং অধিক্ষেত্রের বাহিরে দূরত্বের উপর ভিত্তি করে যৌক্তিক সম্মানী নির্ধারণ করতে হবে। ভ্রমণভাতার হারও যৌক্তিকভাবে পুনঃনির্ধারণ করতে হবে।

৯। জনগুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডের নিরাপত্তা ও জনবহুল এ কার্যালয়ের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ সদস্য অথবা আনসার সদস্য মোতায়েন করতে হবে।

১০। নকলনবিশদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে। এছাড়া অস্থায়ী কর্মচারী যথা: উমেদার, ঝাড়ুদার, নৈশপ্রহরীদে বাস্তবসম্মত বেতন প্রদান করে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ নিশ্চিত করতে হবে।

১১। দলিল লেখকগণের পারিশ্রমিক যৌক্তিক হারে পূনঃনির্ধারণ করতে হবে এবং দলিল লেখক (সনদ) বিধিমালা, ২০১৪ সংশোধন করতে হবে।


উল্লেখ্য যে, জনগণকে কাঙ্খিত ভূমি সেবা প্রদানের জন্য ভূমির সকল সেবাসমূহ যথাক্রমে দলিল রেজিস্ট্রেশন, নামজারি ও জরিপ কার্যক্রমকে একই ছাতার নিচে এনে ভূমি সেবা সার্ভিস গঠন করতে হবে।


জেবি/এসবি